নওগাঁ শহর থেকে আটকের পর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) হেফাজতে সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামে এক নারীর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ।
কমিটিতে নওগাঁর জেলা জজ পদমর্যাদার একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে রাখতে বলা হয়েছে।
তদন্ত সম্পন্ন করে কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া, তদন্তকালে জেসমিনকে গ্রেপ্তারের সঙ্গে র্যাবের যেসব সদস্য জড়িত ছিলেন তাদেরকে দায়িত্ব পালন থেকে সরিয়ে রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মামলা ছাড়াই সুলতানা জেসমিনকে তুলে নেওয়া ও গ্রেপ্তার কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বুধবার (৫ এপ্রিল) বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনোজ কুমার ভৌমিক। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
উল্লেখ্য, গত ২২ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় নওগাঁ শহরের নওযোয়ান মাঠের সামনে থেকে সুলতানা জেসমিনকে আটক করে র্যাব।
এরপর র্যাব হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাঁকে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
২৪ মার্চ সকালে রামেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুসংক্রান্ত প্রকাশিত খবর ২৭ মার্চ হাইকোর্টের নজরে নিয়ে স্বতপ্রণোদিত আদেশ চেয়েছিলেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। পরে আদালতের নির্দেশে ২৮ মার্চ তিনি হাইকোর্টে এ বিষয়ে রিট আবেদন দায়ের করেন।
রিটে র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কারণ ও র্যাবের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়।
ওই দিনই রিট আবেদনের আরজি তুলে ধরে রিটকারী মনোজ কুমার আদালতে বলেন, এ ঘটনায় কোনো বিষয়ও বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। র্যাব গঠন করা হয়েছিল দাগি চোর-ডাকাত, মাদক চোরাকারবারিদের ধরতে।
এই নারীকে (সুলতানা জেসমিনকে) আটক করা হয় ২২ মার্চ। আর ২৪ মার্চ তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এই আইনে কাউকে গ্রেপ্তারের এখতিয়ার পুলিশের থাকলেও র্যাবের নেই। তা ছাড়া, ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুসারে সুলতানা জেসমিনকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, কোনো অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই র্যাব এ ধরনের বেআইনি ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা আজ অসহায়। র্যাব যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে নিয়ে উধাও করে দিচ্ছে। এটি (সুলতানা জেসমিনকে আটক, হেফাজত, জিজ্ঞাসাবাদ) সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে করা হয়েছে।
এ ছাড়া, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সুলতানা জেসমিনের মাথায় আঘাত থাকার কথা বলেছেন, যা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসেছে।
ফলে র্যাবের কর্মকাণ্ড ও নারীর মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন। যে কারণে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে।
এরপর শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন নওগাঁ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাসংক্রান্ত কাগজপত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, সুলতানা জেসমিনের উচ্চ রক্তচাপ ছিল। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র তুলে ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, “এক ব্যক্তির অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ ১১টা ৫০ মিনিটে নওগাঁ সদরের নওজোয়ান মাঠের সামনে থেকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুসারে সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। পরে জনসাধারণের সামনে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। এর আগে আটক ওই নারীর মোবাইল ফোন থেকে অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্য ও নথি উদ্ধার করা হয়”।
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত বলেন, একজন নাগরিক জঘন্য অপরাধী হতে পারে। অত্যন্ত খারাপ কাজ করতে পারে। সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া (প্রসিডিউর) আছে। দিনশেষে আইনগত প্রক্রিয়া অনুযায়ী কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
যখন র্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করল তখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে পুলিশ আটক করলেও একটা কথা ছিল। আইনে তাদের ক্ষমতা আছে।
এই আইনের ৩৯ ধারায় দেখতে পাচ্ছি তদন্তের ক্ষমতা পুলিশ অফিসারকে দেওয়া হয়েছে। এখানে র্যাবের বিষয়টি তো সুর্নিদিষ্টভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। কথা হচ্ছে র্যাব তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছে, এর পরই তাঁকে পুলিশে দেবে। কিন্তু এখানে সেটা দেখা যাচ্ছে না।
হাইকোর্ট কোনো মামলা ছাড়াই নওগাঁর সুলতানা জেসমিনকে র্যাবের হেফাজতে নেওয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত যে প্রক্রিয়া তা আইনগতভাবে কতটুকু সঠিক ছিল তা জানতে চান।
আদালত বলেছেন, আটকের পর সুলতানা জেসমিনকে সম্মানজনক জায়গায় (থানা অথবা কার্যালয়ে) নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল কি না? উঠিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া আইনগতভাবে হয়েছে কি না? তাঁকে একটা অভিযোগের ভিত্তিতে তুলে নেওয়া র্যাবের জুরিসডিকশনে (এখতিয়ার) ছিল কি না? রাষ্ট্রপক্ষকে বুধবারের মধ্যে এসব প্রশ্নের জবাব দাখিল করতে বলেন।
ওই আদেশ অনুযায়ী আজ রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শোনার পর হাইকোর্ট সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন ও তদন্ত কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের প্রতি নির্দেশ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও র্যাব
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত। এতে বলা হয়েছে যে, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছে বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।