ক্ষমতার পালাবদলের পর আফগানিস্তানের অর্থনীতি কেমন হবে? নতুন তালিবান সরকার কীভাবে সামাল দেবে? এটাই এখন মূখ্য প্রশ্ন।
আফগান অর্থনীতি খুবই ছোট। মাথাপিছু আয় এখন ৫১০ ডলারের কাছাকাছি। বিদেশি সাহা্য্যের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। নতুন সরকারের সঙ্গে পশ্চিমি দেশগুলোর সম্পর্ক কেমন হবে, এটা এখনো পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি সিদ্ধান্ত নেয় তার দিকেও সবার দৃষ্টি।
চীন-রাশিয়া খোলাখুলিভাবে নতুন সরকারের পাশে। মধ্যপ্রাচ্যের আরেক অর্থনৈতিক শক্তি কাতার বরাবরই তালিবানের পক্ষে। কাতার থেকেই তালিবান আফগানিস্তানে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছিল। তার পরিণতিতে বিনাযুদ্ধে রক্তপাত ছাড়া কাবুল দখল করেছে তারা।
আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নেতা আব্দুল গণি বারাদার কাতারেই দীর্ঘকাল নির্বাসনে ছিলেন। সার্কের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। তবে সরকারিভাবে এখনও অবস্থান পরিস্কার করা হয়নি। নতুন সরকার গঠিত হলে হয়তো এই প্রশ্নের সুরাহা হয়ে যাবে।
কথা বলেছিলাম বাংলাদেশের একজন স্বনামখ্যাত অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর ও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সম্পাদক ইনাম আহমেদের সঙ্গে। দু'জনই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন।
এইচ মনসুর বলেছেন, আফগানিস্তানের অর্থনীতি খুবই ক্ষুদ্র। দেশটিকে সবসময় আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। সেখানে আমেরিকানদের যাবার আগেও সেটা ছিল। ইদানীংকালে আরও বেশি বিদেশী সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমি বিশ্বের ওপর। এই বিশাল সাহায্যটা যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আফগানিস্তানের জনসাধারণকে সরকার থেকে যে সাহায্য-সহায়তা দেয়া হতো তাও বন্ধ হয়ে যাবে। সেটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে নতুন সরকারের জন্য।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, আমরা আশা করবো, সরকারের অভ্যন্তরীণ যে নীতিগুলো আছে, যেমন নারীদের সম্পর্কে কি করবে, ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কি করবে, কি ধরনের মানবাধিকার আইনের প্রচলন করবে সেই বিষয়গুলোর ওপর বিদেশীরা সতর্ক নজর রাখবে। সেগুলো নিয়ে যদি তারা কাজ করে তাহলে হয়তো আর্থিক সহায়তাটা বহুলাংশে থাকতে পারে।
তিনি বলেন, আফগান অর্থনীতি শুধু আফিম রপ্তানির মাধ্যমে আয় করে সবচেয়ে বেশি। সেটা খুব একটা গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া নয়। তাদেরকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাদেরকে উৎপাদন কার্যক্রম বাড়াতে হবে। বিশেষ করে তাদের যে খনিজ সম্পদ আছে সেটার যথাযোগ্য ব্যবহার করতে হবে। সরকার যদি সত্যিকার অর্থে গঠনমূলকভাবে কাজ করতে চায় তাহলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন খনিজ কোম্পানিগুলোকে তাদের দেশে আনতে হবে। পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সে পরিবেশ শুধু ধর্মান্ধতা দিয়ে হবে না, সেটা সহনশীলভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিদেশীদের এনে তাদের খনিজ সম্পদ যদি তারা ব্যবহার করতে না পারে তাহলে তাদের উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
অর্থনীতিবিদ মনসুর আরও বলেন, তৃতীয় বিষয় হচ্ছে- তাদের কানেক্টিভিটি ইস্যু। আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে গ্যাস লাইন ও ট্রান্সপোর্ট লাইন যাওয়ার সম্ভাবনা খুব ভালো। এশিয়ার জন্য আফগানিস্তান একটা বিশাল বাধা হয়ে আছে। সেই বাধাটা যদি তারা অপসারণ করতে পারে তাহলে তাদের বিদেশী বিনিয়োগ ও কানেক্টিভিটি ডেভেলপ করবে। এটি তাদের উন্নয়নের সহায়ক হবে। কিন্তু এসবই নির্ভর করবে এই সরকার কি ভূমিকা রাখে তার ওপর। মানবাধিকার ও শিশুদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলোর ওপর নির্ভর করবে তাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলা।
পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো যদি সাহায্য বন্ধ করে দেয়, চাপে পড়বে আফগানিস্তানের অর্থনীতি
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সম্পাদক ইনাম আহমেদ বলেন, তালিবানের হাতে কাবুলের পতনের পর যদি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সাহায্য বন্ধ করে দেয় তাহলে আফগানিস্তান অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে যাচ্ছে। তবে চীন এখানে একটা ভূমিকা নিতে পারে। দেশটি এরই মধ্যে তালিবানের ক্ষমতা দখলকে একরকম স্বাগত জানিয়েছে। ভূ-রাজনীতি এবং বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের দিক বিবেচনায় চীনের এখানে কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। ওয়াখান করিডর দিয়ে দেশটি আফগানিস্তানের সঙ্গে যুক্ত এবং এটি হতে পারে চীনের জন্য ব্যবসা বৃদ্ধির একটি সুযোগ।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি এখনও অস্পষ্ট যে, এতদিন ধরে আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে বড় ভূমিকা রাখা ভারতের ওপর কেমন প্রভাব পড়বে। যেই বিমানবন্দর দিয়ে হাজার হাজার মানুষ পালানোর চেষ্টা করছে সেটিও ভারতীয়দের তৈরি। আফগানিস্তানের অর্থনীতির ভবিষ্যত পুরোপুরি নির্ভর করছে তালিবানের আচরণের ওপরে। তারা যদি তাদের পূর্বের ভুল বুঝতে পারে এবং নিজেদের মধ্যে সংস্কার আনতে পারে তাহলে আফগানিস্তানে বিদেশিদের বিনিয়োগে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হতে পারে। তালিবানের সংবাদ সম্মেলনেও পূর্বের তুলনায় তাদের বেশ মধ্যপন্থী মনে হয়েছে। চীন চাইবে এই খেলায় এগিয়ে থাকতে এবং এরপরে আস্তে আস্তে পশ্চিম শক্তিগুলোও প্রতিযোগিতায় পা বাড়াবে।
তাই আফগানিস্তানের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নির্ভর করছে তালিবানের আচরণের ওপরে। এই পরিবর্তন দেশটিকে হয় সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে কিংবা অর্থনীতিকে আরও বড় বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলবে। এর পুরোটা তাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপরেও নির্ভর করছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের ব্যবসা- বাণিজ্য কেমন? এ প্রসঙ্গে ইনাম আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সামান্য পরিমাণে বাণিজ্য রয়েছে। আফগানিস্তানে বছরে মাত্র ৮৫ লাখ ডলার বা ৭২ কোটি ১৮ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি করা হয়, যার বেশিরভাগই ফার্মাসিউটিক্যালস এবং প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার বা ১৭০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয় দেশটি থেকে।