করোনাকালে বাংলাদেশে প্রয়োগ বেড়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের

তানভীর হাসান, ফটো- বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনাকালে বাংলাদেশে ব্যবহার বেড়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের। এ আইনের বিভিন্ন ধারা ব্যবহার করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও তাদের আটকের ঘটনা বেড়েছে।

করোনাকালে বাংলাদেশে ব্যবহার বেড়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের। এ আইনের বিভিন্ন ধারা ব্যবহার করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও তাদের আটকের ঘটনা বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অপব্যবহারের।

সর্বশেষ ঠাকুরগাঁওয়ে হাসপাতালে খাবারের মান নিয়ে রিপোর্ট করে আটক হন সাংবাদিক তানভীর হাসান। এ রিপোর্টটি পূর্ণাঙ্গ পেশাদারিত্ব নিয়ে করার পরও তাকে শুধু আটক নয়, হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। যা সাংবাদিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সাংবাদিকরা তীব্রভাবে এর প্রতিবাদও জানান।

এ মামলার আরও দুজন আসামি হচ্ছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধি আবদুল লতিফ লিটু ও নিউজ বাংলা ডটকমের প্রতিনিধি রহিম শুভ। আবদুল লতিফ লিটু বলেন, ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটের খাবার কেনার অনিয়ম নিয়ে অনেক দিন থেকে তারা পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন। রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট মহলের সবার বক্তব্যও ছিল। তারপরও মামলা দায়ের তাদের বিস্মিত করেছে।

বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত ছয় মাসে দায়ের করা বেশির ভাগ মামলাই সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি নিয়ে। আর মামলার বড় অংশই ঢাকার বাইরে দায়ের করা। মামলা প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট আদালতের একজন আইনজীবী কামরুল ইসলাম জানান, দুই ধরনের মামলা আদালতে দায়ের হচ্ছে। এর মধ্যে ৩০% মামলা দায়ের হয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র ও অনলাইনে লেখালেখির কারণে। আর ৭০% মামলা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে হয়রানি নিয়ে। আর বিচার প্রার্থীদের একটি বড় অংশ নারীরা, যারা সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছেন।

জানা গেছে, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭২টি মামলার মধ্যে ৭০টি দায়ের হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোট ৬৩টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৮৬ জনকে। বেসরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী সাংবাদিক ছিলেন আটজন।

সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পাশাপাশি ঢাকার বাইরে অনেক সাংবাদিক অন্য মামলায়ও হয়রানিতে পড়ছেন। হামলা ও মামলা দুটোর মোকাবেলা করেই তাদের কাজ করতে হয়। হবিগঞ্জে এক ধরনের উৎকণ্ঠা আছে অনেক দিন থেকে। অনেক জেলা শহরে সাংবাদিকদের কাজ করতে হয় প্রভাবশালী মহলের চাপকে সামনে রেখে। অনেক সময় মামলা দায়েরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও এগিয়ে থাকে।

মেইন স্ট্রিম মিডিয়াতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সাংবাদিকরা যাতে হয়রানির শিকার না হন সেদিকে তারা দৃষ্টি রাখছেন। তিনি বলেন, আইনটি করা হয়েছে সাইবার সন্ত্রাসের শিকার নারী, শিশু ও সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য। কাউকে হয়রানি করার জন্য নয়। কারণ বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও সাইবার সন্ত্রাস বাড়ছে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই অভিমত তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের।

তবে বাস্তবতা কী জানতে চাইলে সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, আমরা আইসিটি আইনের বিরুদ্ধে নই। শুরুতেই ৫৭ ধারা নিয়ে আপত্তি করেছিলাম। ৮ থেকে ১০টি ধারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ বলে আমরা অবহিত করেছিলাম সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে। ভেবেছিলাম তথ্য অধিকার আইনই হচ্ছে মত প্রকাশের জন্য সর্বোচ্চ আইন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন দেখতে পাচ্ছি।

সর্বশেষ রোজিনার ক্ষেত্রে অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট ব্যবহার করা হলো। অথচ আইনটি ব্রিটিশ আমলে করা। আর আইসিটি আইনের ২৫, ৩১ ও ৩৩ ধারাগুলো নেতিবাচক বলে সরকারকে অবহিত করেছি বারবার। আমাদের বক্তব্য হলো, সাইবার ক্রাইম যারা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ করুন। ব্যবস্থা নিন। কিন্তু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা দরকার।

সাইবার অপরাধী যারা দেশের প্রধানমন্ত্রী, সংবিধান, জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কটাক্ষ করছে সরকার চাইলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। নারী শিশুরা হয়রানির শিকার হলে কঠোর হতে পারে। তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁওতে পরিচ্ছন্ন সাংবাদিকতা করেছেন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা। তারপর যা করা হলো তা দুঃখজনক।

একই ধরনের অভিমত সাংবাদিকদের আরেকজন নেতা শওকত মাহমুদের। তিনি বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সম্মিলিতভাবে আমরা এই আইনের ৮টি ধারা সংশোধন ও বাতিলের জন্য বলেছি। জামিন অযোগ্য ধারা এভাবে রাখাটাই একটা কালো আইন।

তিনি বলেন, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আইনটি করা হয়েছিল বিশেষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে। ভোট নিয়ে অনিয়মের প্রতিবাদ করতে না পারার জন্যই এ আইনের কঠোরতা। তিনি বলেন, করোনার সময়ে দেখেছি এ আইনের অপপ্রয়োগ বেড়েছে।

প্রয়োগ ও ব্যবহার নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা মনে করেন, করোনাকালে সাইবার অপরাধ বেড়েছে। বিশেষ করে হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী ও শিশুরা। তিনি বলেন, সাইবার ক্রাইম ঠেকাতে অবশ্যই একটি আইনের প্রয়োজন রয়েছে। হয়রানি রোধে এ আইনের প্রয়োগ না হলে সাইবার অপরাধ বাড়বে। বিশেষ করে, নারী ও শিশুরা অধিকভাবে হয়রানিতে পড়বে।

সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ ও মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, আমরা সংশোধনের দাবি করছি। আইনটি বাতিল নয়। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে অবশ্যই একটি আইনের প্রয়োজন রয়েছে।

উল্লেখ্য, আইনটি প্রণয়নের পর প্রথমেই প্রতিবাদ জানিয়েছিল সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ। শুধু বক্তব্য-বিবৃতি নয়, তথ্যমন্ত্রী, আইন ও বিচারমন্ত্রী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সদস্যবর্গ ও সচিবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সম্পাদক পরিষদ তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে। সম্পাদক পরিষদ মেইন স্ট্রিম মিডিয়াকে এই আইন থেকে মুক্ত রাখার দাবিতে রাজপথে মানববন্ধনও করেছিল।