আজ থেকে ১৩০ বছর আগে ১৮৮৯ সালের ১৫ই অগাস্ট। তখনও ভারত বৃটেনের অধীনে, কোনও এক ১৫ই অগাস্ট দেশের স্বাধীনতা দিবস হবে, তখন স্বপ্নেরও অতীত, কিন্তু ঠিক সেই দিনে উত্তর কলকাতার একটা এঁদো গলি মোহনবাগান লেনে খুব সাদামাটা ভাবে একটা ফুটবল ক্লাবের জন্ম হলো, নাম মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব। এর পরের বছর নাম পাল্টে করা হয় মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব। তার পর আরও বহুবার মোহনবাগানের নাম বদল হয়েছে, চরিত্র বদল হয়েছে, খেলোয়াড়ের ধরন বদল হয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস বদলায়নি, সেটা হল মোহনবাগানকে ঘিরে যে আবেগ, জাতীয় চেতনার প্রকাশ এবং অনুভূতি। মোহনবাগান পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের ক্লাব বলে পরিচিত। যাকে বলা হয় ঘটি। তার বহু পরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম হয়েছিল তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙালি পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে। তবে এই মুহূর্তে মোহনবাগানকে নিয়ে বাঙালি আকুল হয়ে রয়েছে এই কারণে যে, নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারের মতো জায়গায় গত ২৯শে জুলাই একটি বিখ্যাত বিলবোর্ডে জ্বলজ্বল করে উঠেছে কলকাতার ক্লাব মোহনবাগানের নাম। যা দেখে বিশ্ব ফুটবল সংগঠন ফিফা পর্যন্ত বলেছে, এ তো খেলা কথা নয়! একটা ক্লাবের নাম যখন টাইমস স্কোয়ারের বিলবোর্ডে শোভা পায়, তখন বুঝতে হবে সে ক্লাবের মধ্যে বাড়তি কিছু আছে। এই বাড়তি কিছুর সন্ধানে বেরোলে দেখতে পাবো ১৯১১ সালে মোহনবাগানের কিছু বাঙালি খেলোয়াড় খালি পায়ে ফুটবল খেলে দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ দলকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতে নিয়েছে। সেটা ছিল একটা ২৯শে জুলাই। তারপর থেকে প্রতিটি ঊনত্রিশে জুলাই মোহনবাগান দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মোহনবাগান নিয়ে বিস্তর কথা বলা যায় তবে আজ আমরা প্রথমে শুনবো একজন বয়স্ক মোহনবাগান সমর্থকের কথা। শান্তিনিকেতন নিবাসী ব্রতীন্দ্র মোহন সেন বিশ্বভারতীর হয়ে ফুটবল খেলেছেন, মোহনবাগান জুনিয়ার টিমের বিরুদ্ধে খেলেছেন। যাঁর বাবা বিএম সেন শান্তিনিকেতনে একজন অভিভাবক স্থানীয় মানুষ ছিলেন, খেলাধুলোর প্রতি অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল, নিজে কলকাতায় ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল খেলতেন।
শান্তিনিকেতনের প্রবীণ বাসিন্দা ব্রতীন্দ্রমোহন সেনের কাছে আমরা মোহনবাগানের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কারণ শুনলাম। এবার আমরা যাব অপেক্ষাকৃত তরুণ কলকাতার বাসিন্দা অর্ক ভাদুড়ির কাছে। অর্ক ভাদুড়ি একজন সাংবাদিক ও গবেষক। আদ্যন্ত ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার, কিন্তু মোহনবাগান নিয়ে তাঁর আবেগ কারও থেকে কম নয়।
অর্ক ভাদুড়ির কথা শুনলাম। চুনী গোস্বামী, যিনি নিজে বাঙাল হয়ে, পূর্ববঙ্গের হয়ে, বরাবর খেলেছেন তথাকথিত ঘটিদের ক্লাব মোহনবাগানে, তিনিও বলেছেন, মোহনবাগান তাঁর কাছে জাতীয় চেতনা ও প্রেরণার উৎস। মোহনবাগানকে তিনি শুধুমাত্র এটা ক্লাব হিসেবে দেখতে পারেননি। মোহনবাগানের একদম প্রথম দিকের খেলোয়াড় গোষ্ঠ পাল, যাঁকে চীনের প্রাচীর বলা হতো, তিনিও ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। সবকিছু ছাপিয়ে মোহনবাগান কিন্তু আজ একটা আবেগের নাম। বিশ্ব ফুটবলে মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গলের নাম কোনও দিন উঠবে না। কিন্তু বাঙালির হৃদয়ে এই দুটি নাম লেখা থাকবে। তাদের চরিত্র বদল হয়ে কর্পোরেট চেহারা পাওয়ার পরও সেই আবেগ বা অনুভূতি একটুও কমেনি।
Your browser doesn’t support HTML5