বাংলা ভাষায় বহু জনপ্রিয় এবং বিপুল সংখ্যক গানের গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। বিবিসি বাংলার এক জরিপে সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান পেয়েছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা তিনটি গান। গানগুলো হচ্ছে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’ এবং ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনারগাঁয়’। অন্যদিকে, জাপান-বাংলাদেশ জরিপে সেরা ২০ বাংলা গানের আটটি তার লেখা। একদিকে তিনি লিখেছেন দেশের গান। অন্যদিকে সত্তর এবং আশির দশকের চলচ্চিত্রের আলোচিত বেশিরভাগ গানের গীতিকার তিনি।
একটা সময় ছিল, চলচ্চিত্রের গান মানেই গাজী মাজহারুল আনোয়ার।
স্মৃতিচারণ করেন নিজের সংগীত ও চলচ্চিত্রে জড়িয়ে পড়া নিয়ে। বললেন, মেডিকেলের ছাত্র ছিলাম। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় এক দিন লাশ কাটা ঘরে প্রবেশ করতে হয়েছিল। ভালো লাগল না লাশ কাটাছেঁড়া করতে। আমি পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়লাম। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আমার মনের টান ছিল। পড়াশোনায় আমার অমনোযোগী ভাব দেখে আমার এক সহপাঠী বলল, তুমি ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা কর।
মেডিকেল কলেজে নাটক হতো। নাটকের জন্য গান লিখতাম। ১৯৬২-৬৩ সালে মেডিকেল ছাত্র থাকাকালে একটি গান লিখলাম ‘বুঝেছি মনের বনে রং লেগেছে’। ফরিদা ইয়াসমিনের গানটি পছন্দ হলো। তিনি রেডিওতে গানটি গাইলেন। তুমুল জনপ্রিয় হলো। এই গানের সুর করেছিলেন নাজমুল হুদা বাচ্চু। কিন্তু গীতিকার হিসেবে আমার নাম প্রচার হলো না। মনে খুব কষ্ট পেলাম। ডাক্তারি পড়া আর হলো না।
মগবাজারের একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকি। গান লিখি। বাবা জানলেন না তার ছেলে ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে গান লিখছে। মেডিকেল থেকে বেরিয়ে আসলাম। পরিবারের কেউ খুশি হননি এ খবরে। বাড়ির ছেলে ডাক্তার হবে এটাই ছিল সবার প্রত্যাশা। কিন্তু সেই প্রত্যাশাকে পিছনে ঠেলে ছেলেটি শুরু করলো গান লিখা। সেই শুরু। ১৯৬৪ সালে রেডিও পাকিস্তানে গান লিখে পেয়েছিলাম ৫০ টাকা। সংগীতে প্রথম অর্থ উপার্জন। ১৯৬৭ সালে যুক্ত হলাম চলচ্চিত্রের সঙ্গে।
প্রথম ছবির গান সুভাষ দত্তের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ চলচ্চিত্রে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বললেন, একদিন সংগীত পরিচালক নাজমুল হুদা আমাকে নিয়ে যান সত্য সাহার কাছে। সত্য দার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। তিনি আমাকে নিয়ে যান চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা সুভাষ দত্তের কাছে। সুভাষ দত্ত তখন ‘সুতরাং’ ছবি বানিয়ে অ্যাওয়ার্ড পেয়ে খুবই বিখ্যাত। সুভাষ দত্ত আমাকে দেখে সত্য দাকে বললেন, এই ছেলেটাকে কোথা থেকে ধরে এনেছ? সত্য দা বললেন, দাদা ও গান লেখে। ওকে নিয়ে ট্রাই করে দেখুন না। জবাবে তিনি বললেন, দূর, আমি সুভাষ দত্ত। আমার ছবির গান ও কীভাবে লিখবে? সত্য দা একটু বিব্রত হয়ে বললেন, দাদা এসেছে যখন দেখুন না, কিছু একটা হতেও পারে। আপনি ছবির গানের একটি সিচুয়েশন দেন। সুভাষ দত্ত অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে শিক্ষক ছাত্রীকে পড়াচ্ছেন এই সিচুয়েশনের ওপর একটা গান লিখো। এতটুকু বিষয় নিয়ে কী গান লিখব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তারপরও পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের মধ্যে গানটি তৈরি করে ফেললাম। গানের কথা ছিল, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, বাতাসের আছে কিছু গন্ধ’। সত্য সাহা সুর করে সুভাষ দত্তকে গানটি শোনালেন। তিনি গানটি শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তোমার চেহারা আর গোঁফ দেখে মনেই হয়নি তোমার মধ্যে ম্যাচুয়িরিটি এসেছে। তুমি এমন গান লিখতে পারবে।
গান লেখা নিয়ে আরেকটি মজার ঘটনা জানালেন মাজহারুল আনোয়ার। বললেন, ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে জন্ম। মায়ের জরুরি খবর পেয়ে গিয়েছিলাম কুমিল্লায়। গিয়ে দেখলাম জরুরি কিছু নেই। আসলে মা হাঁস কিনেছেন আমাকে খাওয়াতে। এর মধ্যে বাসায় ফোন করলেন আনোয়ার পারভেজ। বললেন, তুমি চলে গেলে কুমিল্লায়। গান দরকার জরুরি। জবাবে বললাম ছবির সিচুয়েশন বল। পরিচালক সিচুয়েশন বুঝিয়ে বললেন। বললাম, ৩০ মিনিট পর আবার ফোন করতে। গান লিখে ফেললাম। ৩০ মিনিট পর আবার ফোন এলো। আমি গানটি বললাম, তারা লিখে নিল। ছবির নায়ক-নায়িকা ছিলেন রাজ্জাক, কবরী। কিন্তু গান নিয়ে বিপত্তি বাধলো। কবরী বললেন, এই গানে ঠোঁট মেলাবো না। কারণ দর্শক গানটি ভালোভাবে নেবে না। সমস্যা পড়লেন পরিচালক। ঢাকায় ফেরার পর সমস্যার কথা জানালেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ারও বললেন, গান নতুনভাবে দিতে পারব না। শেষ পর্যন্ত ঠোঁট মেলালেন কবরী। গানটি হলো, ‘‘সে যে কেন এলো না, কিছুই ভালো লাগে না, এবার আসুক তারে মজা দেখাবো।’’ ছবি মুক্তির পর গানটি হিট করে যায়। কবরী তখন মহাখুশি। এমন অনেক গল্প আছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের জীবনে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার একাধারে একজন সফল গীতিকার, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার ও চিত্রপরিচালক। একজন মানুষের এর চেয়ে বেশি কি লাগে? দেশাত্মবোধক, আধুনিক ও চলচ্চিত্রের অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা। এত গান লেখা নিয়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, এ দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক গান লেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এ পর্যন্ত ২০ হাজারেরও বেশি গান লিখেছি। কিন্তু সব গান আমার সংরক্ষণে নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের যে ফাঁসির তালিকা তৈরি করেছিল তাতে ১৩ নম্বরে ছিলাম আমি। আমাকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। পরে ফিরে দেখি বাসায় থাকা আমার গানের পাণ্ডুলিপি আর নেই। এরপর রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখি সেখানেও আমার গানগুলো নেই। পাকবাহিনী বাঙালিদের সব সৃষ্টিকর্ম ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমার রচিত প্রচুর গান হারিয়ে গেছে। তবুও রয়ে গেছে হাজার হাজার আলোচিত গান। সেই গানগুলোর কয়েকটি হলো জয় বাংলা বাংলার জয়, একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল, একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনারগাঁয়, জন্ম আমার ধন্য হলো, গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, ও পাখি তোর যন্ত্রণা, ইশারায় শীষ দিয়ে, চোখের নজর এমনি কইরা, এই মন তোমাকে দিলাম, ও আমার রসিয়া বন্ধু রে...।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০০২ সালে একুশে পদক পান। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ডসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তার অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ১১০। গাজী মাজহারুল আনোয়ার কিছু ছবিও করেছেন। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল দেশ চিত্রকথা। তাঁর প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবিগুলোর মধ্যে আছে, সমাধি, শাস্তি, স্বাধীন, শর্ত, সমর, শ্রদ্ধা, সন্ধি, ক্ষুধা, স্নেহ, তপস্যা, উল্কা, আম্মা, পরাধীন, আর্তনাদ, পাষাণের প্রেম, জীবনের গল্প, এই যে দুনিয়া।