নির্বাচন কমিশন গঠনের সংলাপে সমঝোতার সম্ভাবনা কমে আসছে 

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ভবন

নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে সমঝোতার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। কারণ বিএনপি, বাসদ, সিপিবি, ইসলামী আন্দোলনসহ একাধিক দল ইতিমধ্যে সংলাপে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এমন কি এর আগের ইসি গঠনের সংলাপে যারা অংশ নিয়েছিল তারাও এবার সংলাপে যাচ্ছে না। এই অবস্থায় সংলাপ থেকে কোনো ফলাফল আসবে কিনা তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে প্রেসিডেন্টের ডাকা সংলাপে এ পর্যন্ত অংশ নেয়া দলগুলোর বেশির ভাগই আইন প্রণয়নের পরামর্শ দিয়ে এসেছে। যদিও সরকারের তরফে বলা হচ্ছে আইন প্রণয়ন করার মতো সামনে যথেষ্ট সময় নেই। এতে অনেকে মনে করছেন পুরনো পদ্ধতি সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে যাচ্ছেন।

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপের জন্য এ পর্যন্ত ৯টি দলকে ডাকা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল- বাসদ সংলাপে অংশ নেয়নি। দলটির তরফে বলা হয়েছে, আগের দুই সংলাপে যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে তা এখনও প্রাসঙ্গিক। তাই নতুন করে সংলাপের প্রয়োজন নেই।

শনিবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংলাপে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একইদিন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপে অংশ না নেয়ার কথা জানিয়েছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। এই মেয়াদের মধ্যেই পরবর্তী কমিশন গঠনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

শনিবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর আমীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম সংলাপে না যাওয়ার ঘোষণা দেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের প্রধান যখন কোনো সংলাপের আমন্ত্রণ জানান, তখন তাতে সাড়া দেয়া নাগরিক দায়িত্ব বোধের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এই বোধ থেকেই আমরা ২০১২ ও ২০১৭ সালের সংলাপেঅংশ নিই।কিন্তু গত দুই কমিশনের অধীনে যে দুটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে এগুলো এতটাই বিতর্কিত ও জালিয়াতিতে পূর্ণ যে রীতিমতো হতাশা ও লজ্জাজনক। এমন অবস্থায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপকে অর্থহীন বলে মনে করে আমার দল”।

শনিবার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সংলাপে অংশগ্রহণের বিষয়ে অপারগতা জানিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। আগামী সোমবার দলটির সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সংলাপের সূচি রয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, সিপিবি নির্বাচনের আমূল সংস্কারের জন্য সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বসহ ৫৩টি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের সুপারিশমালা ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপে পেশ করা হয়েছিল। এই অবস্থায় হুবহু একই আলোচ্যসূচিতে ও একই প্রকরণের আরেকটি সংলাপে যোগ দিয়ে সিপিবির নতুন কোনো কথা বলার নেই।

সংলাপ নিয়ে দলগুলোর মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই শনিবার এক অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান এ বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সার্চ কমিটি গঠন করা হলেও সরকার তার পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, বর্তমান কমিশনও চাইলে তার ক্ষমতা অনুযায়ী ভালো নির্বাচন করতে পারতো। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি।

ওদিকে নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রেসিডেন্টের ডাকা সংলাপে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগই আইন প্রণয়নের পরামর্শ দিচ্ছে। সংলাপে এ পর্যন্ত যেসব দল অংশ নিয়েছে তাদের প্রায় সবাই সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী কমিশন গঠনে একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে।

গত ২০শে ডিসেম্বর ইসি গঠনের লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। এদিন জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ৮টি দল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপ করেছে। দলগুলোর তরফে ইসি গঠনে নানা পরামর্শ এলেও তারা প্রায় সবাই সংবিধান অনুযায়ী একটি আইন প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন।

সংলাপে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে। তবে সময় স্বল্পতার কারণে আইন প্রণয়ন সম্ভব না হলে প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশের মাধ্যমে ইসি গঠন করতে পারেন বলেও মনে করে দলটি। বিকল্প হিসেবে ইসি গঠনে সার্চ কমিটির জন্য চারজন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে একজনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে দলটির তরফে।

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক জোট মিত্র জাসদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় ২২শে ডিসেম্বর। এতে দলটির সাত সদস্যের প্রতিনিধি অংশ নেন। দলটির তরফে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের তাগিদ থাকলেও এখন পর্যন্ত আইন প্রণীত না হওয়াটা দুঃখজনক।

গত ২৮শে ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপ করে ১৪ দলীয় জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। দলটির পক্ষ থেকেও ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সংলাপের পর দলটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জানান, তিনি মনে করেন ইসি গঠনে আইন প্রণয়ন একদিনের বিষয়। অতীতে এ ধরনের আইন একদিনেই করা সম্ভব হয়েছে।

২৬শে ডিসেম্বর সংলাপে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সংবিধান অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট আইনি কাঠামো তৈরিসহ সাত দফা প্রস্তাবনা দেয়।

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে আইন প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছে তরীকত ফেডারেশন। সার্চ কমিটি হলে সাংবাদিক-সুশীল সমাজের প্রতিনিধি রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে দলটির তরফে। ২৭শে ডিসেম্বর দলটির নেতারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপে বসেন।

২৯শে ডিসেম্বর সংলাপে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ ও ইসলামী ঐক্যজোট অংশ নেয়। বিএনএফ প্রেসিডেন্টের কাছে তিন দফা প্রস্তাব দিয়েছে।

সংলাপে অংশ নিয়ে ইসলামী ঐক্যজোট চার দফা প্রস্তাব দিলেও সার্চ কমিটির জন্য কারও নাম প্রস্তাব করেনি। সংলাপে বিএনএফ'র পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আইন প্রণয়ন, সার্চ কমিটি গঠন ও পাঁচটি নাম প্রস্তাব এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়।

সংলাপে অংশ নিয়ে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে ইসলামী ঐক্যজোট। এছাড়া “ঈমানদার” ব্যক্তিদের অনুসন্ধান কমিটিতে রাখা, নির্বাচন কমিশন গঠনে স্থায়ী আইন করা, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ সহযোগিতা করা ও নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ করার প্রস্তাব দেয়া হয় দলটির তরফে।

নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সবক’টিকে সংলাপে পর্যায়ক্রমে আমন্ত্রণ জানানো হবে। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনও সংলাপের আমন্ত্রণ পায়নি। যদিও বিএনপি সংলাপে না যাওয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে ইতিমধ্যে।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিষ্টার আন্দালিব রহমান পার্থ জানিয়েছেন, তার দল এখনো সংলাপের কোনো চিঠি পায়নি। তবে সংলাপের আমন্ত্রণ পেলে অংশ নেয়ার বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগেরসাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার (বীর প্রতীক) জানিয়েছেন, তারাও সংলাপের চিঠি পাননি। চিঠি হাতে পেলে দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে। সেখানে চিঠির আলোকে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।

বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (এম.এল) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া জানিয়েছেন, ৪ঠা জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় সংলাপের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। সংলাপে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দেয়া হবে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানাবে তার দল।

(মতিউর রহমান চৌধুরী)