করোনাকালে কেমন যাচ্ছে নার্সদের দিনকাল

বাংলাদেশের একজন নার্স ঢাকা মেডিকেল কলেজ ভ্যাকসিনেশন সেন্টারে একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে কোভিড টিকা দিচ্ছেন

করোনা মহামারীর সময় ডাক্তারদের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন নার্সরা। এই করোনাযুদ্ধে সম্মুখসারির যোদ্ধাদের সময় কেমন যাচ্ছে তা আমাদের জানিয়েছেন এ পেশায় নিয়জিত কয়েকজন। ​

রুফাকা তাজনীন রিক্তা

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

করোনার প্রথম ঢেউ যখন আসলো সেই পরিস্থিতি আপনি কিভাবে মোকাবেলা করেছেন জানতে চাইলে রুফাকা তাজনীন রিক্তা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন- আমরা মোটামুটি ২বছরের মত পার করলাম এই কভিড-১৯ মহামারীর সাথে। প্রথম ২০১৯ সালের শেষের দিকে যখন এই ভাইরাস আসে তখন তো আমরা সবাই অনেক আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম। এটা আসলে কোন ধরনের রোগ, রোগীদের অবস্থা কেমন হয়। জাস্ট একটা অন্যরকম ভীতি কাজ করতো। আস্তে আস্তে যখন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে আমরা অনেক কিছু জানলাম, শিখলাম কিভাবে আমরা প্রতিকার করতে পারি। আমাদের কাছে একটা ম্যানুয়াল চলে আসলো আমাদের কিভাবে নিরাপদে থাকতে হবে কিভাবে রোগীদের ভালো রাখতে হবে। রোগীদের আমরা কিভাবে মেন্টাল সাপোর্ট দিতে পারি। পরিবেশটা আমরা মোটামুটি নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে আসলাম।

রুফাকা তাজনীন রিক্তা

এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলে এসেছে। পরিবেশটা আসলেই সত্যি অনেক বেশী আমাদের জন্য কষ্টদায়ক। অনেক রোগী আমাদের হাসপাতালে আসছে। আমরা দেখছি মানুষের আহাজারি আর্তনাদ লাশ দেখা যাচ্ছে গেটেই। আমাদের রাজশাহী মেডিকেলে অনেক গুলো ওয়ার্ড। ৮/৯টা ওয়ার্ড করোনার জন্য খুলে দিয়েছে। ওয়ার্ডগুলো একদম পরিপূর্ণ এবং বারান্দায় ও রোগী রাখতে হচ্ছে এতো বেশী রোগীর চাপ।

আমাদের অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পার হতে হচ্ছে। অনেক রোগী চলে আসে কিন্তু আমরা জায়গা দিতে পারছিনা । এই সময় আমাদের ডিরেক্টর স্যার খুব দৃঢ়হস্তে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন। ওয়ার্ডগুলোকে রাতারাতি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডগুলো থেকে কিছু ওয়ার্ড নিয়ে কোভিড-১৯ ওয়ার্ড করে দিয়েছেন। যাতে রোগীরা ঠিকমত চিকিৎসা পায়। আমরা যারা সেবা দিচ্ছি তাদের পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট এবং আমাদের প্রশিক্ষণ দিলেন। এখন আমরা রোগীদের মোটামুটি সেবা দিতে পারছি।

প্রথম যখন করোনা রোগের ওষুধ আসেনি চিকিৎসার অভাবে রোগী চোখের সামনে মারা যেত তখন আপনার কেমন অনুভূতি ছিল জানতে চাইলে রিক্তা বলেন-ঐ সময়টা আমরা বেশী হেল্পলেস ফিল করতাম। আমাদের সামনে একজন ইয়াং মানুষ মারা যাচ্ছে বা একই পরিবারের ২/৩ জন একই রোগে মারা যাচ্ছে পরিবারটা একবারে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে তখন আমরা খুব অসহায়বোধ করতাম। সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতাম আমরা এই পরিস্থিতি যেন মোকাবেলা করতে পারি। ওই সময় আমরা খুব হেজিটেট ফিল করতাম কি দিলে ওনারা ভাল ফিল করবে। রোগীদের মনে একটা ভীতি যে আমি মারা যাচ্ছি আমার এমন একটা কঠিন অসুখ হয়েছে আমি আর বাঁচবোনা আমার পরিবারের কারো সাথে দেখা করতে পারবোনা।

আইসোলেশনে থাকার ব্যাপারটা আসলেই খুব কঠিন। আমরা চোখের সামনে থেকে দেখেছি একজন মানুষ একা একা কতটা অসহায় ফিল করে । আবার অনেকে দেখা যাচ্ছে যে ভয়ে আপনজন রেখে হয়তো কাছে আসছেনা তার মধ্যে ভীতি কাজ করছে। এই কঠিন ভাইরাসে আমিও আক্রান্ত হতে পারি। এই পরিস্থিতি দেখে খারাপ লেগেছে অসহায়বোধ করেছি ।

এই সব রোগীর সেবা দিতে গিয়ে আপনি ভয় পেতেন কিনা বা আপনি কভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন কিনা প্রশ্ন করলে রিক্তা বলেন- হ্যাঁ ভয় তো অবশ্যই পেতাম আমার একটা ছোট বেবী আছে এবং আমার পরিবারের সদস্যরা যেন ঠিক থাকে তার জন্য অনেক সতর্ক থাকতাম।

কিভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রেখেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন- আমরা যেহেতু হেলথ ওয়ার্কার আমি এই প্রফেশনে আছি সেহেতু আমি মেন্টালি নিজেকে স্ট্রং রাখার চেষ্টা করেছি। এই মানুষদের পাশে আমাকেই থাকতে হবে, না হলে কে থাকবে। তারপরে যতটুকু নিজেকে প্রটেক্ট করা যায় আমি গ্লাভস পরেছি,মাস্ক ইউজ করেছি তারপর আমি যে ড্রেসটা পরি সেটা হাসপাতালেই চেঞ্জ করে পলিথিনে ভরে বাসায় নিয়ে গিয়ে সাথে সাথে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেলি।

এই যে পিপিই পরে আপনারা ডিউটি করেন এটা পরে কত ঘন্টা থাকতে হয় এবং কেমন অনুভব করেন জানতে চাইলে রিক্তা বলেন-পিপিই পরা তো অনেক বেশী কষ্টের । কিছু দিন আগে একজন পিপিই পরে মেডিসিন দিতে গেছেন ৩/৪ জন রোগীকে ওষুধ দেওয়ার পরে তিনি সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেছেন। গরমের মধ্যে তার এটা সহ্য হয় নাই। এরকম পিপিই পরে থাকা খুবই কষ্ট। তারপর মাস্ক পরে থাকা তো অনেক বেশী কষ্টের ২/৩টা মাস্ক পরে থাকতে হয় । বেশীক্ষণ এন-৯৫ মাস্ক পরে থাকলে মুখে দাগ হয়ে যায়। তারপরও পরে থাকতে হয় নিজের সুরক্ষার জন্য, ফ্যামিলির প্রটেকশনের জন্য।

সব কিছু ছেড়ে এই পেশায় আসলেন কেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন- ছোট বেলা থেকেই আমার বাবা বলতো মানুষের পাশে থাকতে হবে, মানুষের সেবা করতে হবে। মানুষের কাছাকাছি যাওয়া মানুষের আর্শীবাদ নেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো পেশা আর হয় না।

বাবার এই কথাটা মাথায় ছিল। আর আমার বাবা ছোট বেলায় মারা গেছেন। তার এই স্বপ্নটা আমাকে আলোড়িত করে। তখন আমি নিজে নিজেই এই পেশাটাকে ভালোবাসলাম এবং এই পেশায় আসা হলো।

আপনার স্বামী ভয় পায় কিনা জানতে চাইলে রিক্তা বলেন- না আমার স্বামী আমাকে পুরোপুরি সাপোর্ট করে। সে সব সময় বলে তুমি যতটুকু পার করো আর নিজের সেইফটির জন্য যে সব ইকুইপমেন্ট লাগে সেগুলো আমার জন্য নিয়ে আসে।

বাইরে থেকে এসে বাচ্চাকে ধরতে পারেননা আদর করতে পারেননা সে ক্ষেত্রে আপনার কেমন লাগে জানতে চাইলে রিক্তা বলেন – অবশ্যই খারাপ লাগে। বাচ্চা তো অপেক্ষা করে কখন মা মনি আসবে। আমার বাচ্চার ২বছর বয়স সারাক্ষণ গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। অফিস থেকে আসার আগেই আমার শ্বাশুড়ি বা আমার আম্মুকে কল করে বলে দেই ওকে যেন একটু আড়ালে নিয়ে যায় আমাকে যেন না দেখতে পায়। আমি যথাযথভাবে ক্লীন হয়ে তারপরে বাচ্চার কাছে যাই।

আপনার চোখের সামনে বা আপনার হাতের উপরে রোগী মারা গেছে এমন কোন পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে রিক্তা বলেন- খুব শ্বাস কষ্ট নিয়ে রোগী আসে শেষের দিকে তার লাংগস যখন আক্রান্ত হয়ে যায় অক্সিজেন লাগাতে লাগাতে রোগীটি মারা গেল। যখন একটা লাশ দেখি বা হ্যান্ডল করি তখন অনেক বেশী খারাপ লাগে ওই খারাপ লাগাটা প্রকাশ করা যায় না।

কোভিড-১৯ নিয়ে অনেকে ভয় পায়। মনে করে রোগীর কাছে গেলেই হয়তো আমি আক্রান্ত হবো। আমরা ডিউটি করছি পেসেন্টকে হ্যান্ডেল করছি যদিও নিজেকে নিরাপদে রেখে। রোগী যখন কথা বলে শ্বাস নেয় এই ব্যাপার গুলো একটু এভোয়েড করলে একটু সেভ রাখলে নিজেকে প্রটেক্ট করা সম্ভব। কারণ আমাদের সরকার এখন যথেষ্ট সাপোর্ট দিচ্ছে, পর্যাপ্ত মেডিসিন ও ইকুইপমেন্ট সাপ্লাই দিচ্ছে । সুতরাং আমরা যদি ভয় না পেয়ে স্ট্রংলি এটা মেইনটেইন করি তাহলে আমি মনে করি আল্লাহর রহমতে আমরা কোভিড-১৯কে মোকাবেলা করতে পারবো। আমরা অবশ্যই মাস্ক ছাড়া নিশ্বাস নিতে পারবো সুস্থ্য পৃথিবীতে।

জান্নাতুন নেসা

ডিএসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল

আমার নাম জান্নাতুন নেসা। আমার জেলা বগুড়া। আমি বর্তমানে আর্মড ফোর্সেস নার্সিং সার্ভিস অর্থাত্ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে একজন নার্স হিসেবে নিয়োজিত আছি। যখন থেকে সারা বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাস হিসেবে ঘোষিত হয় তখন থেকে আমরা করোনা সংক্রমিত রোগিদের চিকিত্সার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতল যেটাকে সিএমএইচ নামে সবাই চেনে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে আমাকে ডিএনসিসি করোনা আইসোলেশন সেন্টারে পাঠানো হয় । সেটা যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র । আমি সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে কাজ করে অভ্যস্ত। সিভিল এরিয়াতে কখনো আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। সে ক্ষেত্রে আমি একটু টেনশন নিয়েই সিভিল এরিয়াতে আসি। এ জায়গায় তখনো হাসপাতাল হয় নাই। আমি আসার পরে আমাদের তত্ত্বাবধানে এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে এসে সবার সাপোর্ট পাবো কিনা এটা নিয়ে একটু টেনশন কাজ করতো। এখানে আসার পরে করোনার যে প্রথম ধাক্কাটা বা ঢেউটা চলে যাওয়ার পরে এটা তখন আর হাসপাতাল না হয়ে এটা ডিএনসিসি করোনা আইসোলেশন সেন্টার হলো। সেখানে বিদেশগামী যাত্রীদের স্যাম্পল কালেকশন কাজে নিয়োজিত ছিলাম। তখন প্রতিদিন যাত্রী ছিল ২০০০থেকে ৩০০০জন। এমনও হয়েছে আমাদের ৫০০০জন বিদেশগামী যাত্রীরা করোনা টেস্ট এর জন্য এসেছে। এখন হচ্ছে করোনাভাইরাস এর দ্বিতীয় ঢেউ সেটা সারাবিশ্বে চলে আসছে। এটা যখন শুরু হয়ে গেল তখন এই আইসোলেশন সেন্টারটা হাসপাতালে রূপ নেয় তখন জাস্ট একটা ফ্যান ছিল আর কিছুই ছিলনা। তখন আমাদেরকে বলা হলো আমরা এখানে আছি মাত্র ৫ জন। আমাদেরকে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ভাগ করে দিয়ে বলল আপনার তত্ত্বাবধায়নে পুরোটা চালিত হবে। তখন আমাদের না কোন ইকুপমেন্ট না কোন স্যাম্পল কোন কিছুই ছিল না। এখান থেকে আমাদের ডিরেক্টার স্যার ও প্রশাসন যারা আছে আমাদের তারা কন্টিনিউ গাইড করছেন। ওনারা বলছেন তোমরা কাজ করো কোন রকম ভয় পেয়ো না। তোমরা যখন চাকরিতে জয়েন করেছো তখন একথা বলেই জয়েন করেছ সমরে ও শান্তিতে রাখিবো সুস্থ। যখন শান্তিকালীন ছিল তখন তো তোমরা সবাইকে সুস্থ রেখেছ এখন তো যুদ্ধের সময় সেখানেও তোমরা সবাই কে সুস্থ রাখবে এই প্রত্যাশা নিয়ে তোমরা কাজ শুরু করো। আমরা এই ওয়াদা নিয়েই চাকরিতে জয়েন করেছি।

জান্নাতুন নেসা

প্রথম যেদিন হাসপাতাল উদ্বোধন হয় কোভিড ডিপার্টমেন্ট আমার অধীনে ছিল। একবারে ৭/৮ জন রোগী আসলো তখন আমার বেড মাত্র ছয়টা এখান থেকে রোগিকে শিফট করে দিতে হবে ইমারজেন্সিতে। আমি এখান থেকে রোগী শিফট করে দিয়ে ইমারজেন্সিতে গিয়ে দেখি সবাই বলছে আমাদের বিভিন্ন জিনিসের প্রয়োজন এখন আমরা কি করব? তখন আমি বলেছি আমাদের কিছুই নাই কিন্তু আমাদের দুটো হাত পা তো আছে। আমরা রোগী রিসিভ করি আমাদের অক্সিজেন দেয়ার মত সামর্থ্য আছে। মুমূর্ষ রোগীদের ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন- হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে অন্য হাসপাতালের আইসিইউ থেকে আমাদের এখানে রুগী শিফট করে নিয়ে আসছে। আমাদের এখানে আইসিইউ বেড আছে কিন্তু তখনও আমাদের আইসিইউ চালু হয় নাই। মুমূর্ষু রোগী একবারে আইসিইউ থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসছে তখন এই রোগীকে তো আমাদের আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হবে।

তখন স্যারদের বললাম আইসিইউ থেকে রোগী নিযে এসেছে এখন আমি কি করব। তখন স্যাররা বলল আমাদের কাছে হাইপো আছে তোমরা রোগীকে হাইপো লাগায় দাও আমি আমার সহযোগীদের নিয়ে তিন-চারটা রোগীকে একসাথে হাইপো লাগিয়ে দিলাম। হাইপো লাগানোর ফাংশন টা আমি আগে থেকেই শিখে নিয়েছিলাম। হাইপো দেওয়ার কাণে শ্বাসকষ্ট অনেকটা রিকভার হয়ে গেছে। ২ঘণ্টার মধ্যে আমি বিশ পঁচিশটা রোগী রিসিভ করলাম। অ্যাটে-টাইম দাড়িয়ে পিপিই পরে রুগী রিসিভ ক‌রি। যেটা আমার অথরিটি আমাকে বলে নাই। এটা আমি করেছি আমার নিজের দায়িত্ববোধ থেকে।

এই যে রোগীদের সেবা করতে করতে আপনার সামনে এরকম কোন কিছু দুর্ঘটনা বা কষ্টের কোন স্মৃতি আছে কিনা জানতে চাইলে জান্নাতুল নেসা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন- আমার দেখা অনেক ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে কষ্ট লেগেছে একটা বেসরকারি হাসপাতালে থেকে প্রেগনেন্সি রুগী নিয়ে এসেছিল। আমরা রিসিভ করলাম তারপরে রোগীটাকে হাইপো দিয়ে সাপোর্ট দিলাম দেয়ার পরেও দেখলাম যে তাতেও কাজ হচ্ছে না। তখন আইসিইউতে শিফট করলাম। পরের দিন শুনি রোগী টা মারা গেছে। শুনে এত কষ্ট লাগছে যে মা ও সন্তান দুজনেই আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আর একটা রোগী এসেছিল সেই মেয়েটার বয়স ছিল ২৫বছর। খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। দেখে খুব ফ্যাকাশে মনে হচ্ছিল। আমি তাড়াহুড়া করে রোগীটাকে রিসিভ করে যখন সেচুরেশন দেখছি পঞ্চাশের নিচে চলে এসেছে। আমার নিজের চোখের পানি চলে এসেছে। এই রোগীকে আমি কতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে পারব আমি জানিনা। আল্লাহকে আমি ডাকতে থাকলাম। রোগীটাকে আমি হাইপো দেওয়ার পরে দেখলাম অক্সিজেন স্যাচুরেশন অনেকটা বেড়ে গেছে। আমি আল্লাহকে বললাম আল্লাহ তুমি আমাকে সহায়তা করেছে বলেই আমি এই রোগীটাকে বেটার কন্ডিশনে নিয়ে আসতে পারলাম। ওনার যে আরও কিছু প্রবলেম ছিল তার রিলেটিভরা আমার কাছে লুকিয়েছে। হঠাৎ করে দেখি অক্সিজেন স্যাচুরেশন ডাউনহতে শুরু করেছে। পরে রোগীর কাগজপত্র চেক করে ওনার টিবি ডিজিজ, লিভার ডিজিজ আরো অনেক সমস্যা আছে। তারপর আমি দেখলাম না এই রোগীকে তো আমার পক্ষে বাঁচানো সম্ভব না জাস্ট আমি রোগীকে আইসিইউ রেডি করে শিফট করতে করতে আমার চোখের সামনে রোগীটি মারা গেল। আমি স্তম্ভিত এত সুন্দর একটা মেয়ে আমার নিজের হাতের উপর মারা গেল। আমি কিছুই করতে পারলাম না। এই জায়গায় আমি সবচেয়ে অসহায় আমি খুবই হেল্পলেস। ঈদের আগের দিন হঠাৎ করে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন ব্লক হয়ে অনেক রোগী মারা গেল। তখন আমি লাশ গুনবো নাকি রোগীর অ্যাটেনডেন্সদের সান্তনা দিব। এতগুলো লাশ আমি জীবনে কখনো একসাথে দেখি নাই। এমন অভিজ্ঞতা সারা জীবন মনে থাকবে।

করোনা হাসপাতালে ডিউটি করে বাসায় ফিরলে পাড়া-প্রতিবেশীর কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্য আছে কিনা জানতে চাইলে জান্নাত বলেন- যেহেতু আমরা ক্যান্টনমেন্টে থাকি সেহেতু ওরকম কোন পরিস্থিতিতে পরতে হয়নি। কারণ এখানে আমরা যারা থাকি আমাদের সবাই আশেপাশে মেডিকেল পার্সন, মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ও ডক্টর এরকম পরিবেশে আমরা আছি। আমরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছি সকাল আটটায় আসি বিকাল পাঁচটায় বাসায় যাই পুরো ফ্যামিলি সাপোর্ট করছে বলে এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। তা না হলে আমাদের পক্ষে এই পেশায় কাজ করা সম্ভব হতো না।

আশরাফুল আলম সিদ্দিকী

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

আশরাফুল আলম সিদ্দিকীর নার্সিং পেশায় ২০১৫ সাল থেকে যাত্রা শুরু। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন হামিম গ্রুপ, আইসিডিডিআরবি মহাখালী। তারপর সরকারি চাকরি হয় ২০১৮সালে। বর্তমানে ময়মনসিংহে করোনা ইউনিটে ডিউটি করছেন।

আশরাফুল আলম সিদ্দিকীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এই করোনা ইউনিটে ডিউটি করতে আপনি কতটা চ্যালেঞ্জ মনে করেন এবং এই কাজ করতে কি কি অভিজ্ঞতা হয়েছে। তিনি বলেন- করোনার শুরুতে অনেক ভয় লাগতো কি হয় না হয় এ নিয়ে। করোনা রোগী দেখলে অনেক দূর থেকেই ভয় পেতাম কিন্তু এখন আর সেরকম ভয় পাইনা। প্রটেকশন নিয়ে আমরা কাজ করছি। যেহেতু এই পেশায় এসেছি কাজ তো করতেই হবে রোগীদের সেবা দিতেই হবে। তাই প্রটেকশন নিয়ে রোগীর অনেক কাছে চলে যাই। পিপিই পরি, সিল্ড ও হ্যান্ড গ্লাভস পরি।

আশরাফুল আলম সিদ্দিকী

পিপিই পরে কাজ করা কমফোর্ট ফিল হয় ‌কিনা জানতে চাইলে আশরাফুল বলেন- অনেক গরম লাগে আর আমাদের সব ওয়ার্ড গুলো তো আর এসি করা থাকে না। নার্সদের ৩ শিফটে ডিউটি করতে হয় যেমন সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ২ টা, দুপুর ২ টা থেকে রাত ৮ টা,আবর রাত ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত ১২ ঘন্টা।
যখন প্রথম আমি পি পি ই পরি আমি দুই ঘণ্টার মধ্যেই অস্থির হয়ে যেতাম। করোনা ইউনিটে সব জায়গাতেই করোনা রোগী। সেজন্য পিপিই পরে ডিউটি করতে হয়।

করোনা ইউনিটে সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে করোনা রোগীর সাথে যে লোকগুলো আসে তারা মাস্ক পরতে চায়না। এমনকি করোনা রোগীরাও মাস্ক পরতে চায়না। রোগীর এটেনডেন্টসরা হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকে। এরাই বাংলাদেশ করোনা ছড়াচ্ছে।
একটা করোনা ওয়ার্ডে ৮০/ ৯০ জন এমনকি ১০০ জনের উপরেও রোগী থাকে। আমরা সকাল শিফটে ১২ জন বা ১৪ জন নার্স থাকি তাতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়।

নার্সিং ট্রেনিংটা কত মাসের জানতে চাইলে তিনি বলেন নার্স ট্রেনিং নেওয়া হয় আসলে দুই ধরনের। এক ধরনের হচ্ছে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে তাদের চার বছরের বিএসসি ইন নার্সিং করতে হয়। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির আন্ডারে থেকে আরেকটা হচ্ছে ডিপ্লোমা এটাও ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর করতে হয়। কিন্তু এটা তিন বছরের কোর্স ডিপ্লোমা ইন নার্সিং।

করোনার সময় কাজ করতে গিয়ে আপনার সামনে কোন রোগীর মৃত্যু হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন- করোনাতে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। একদিন একজন রোগী নিয়ে এসে বলেন আমি ডাক্তার আমার বাবাকে নিয়ে আসছি খুব ইমারজেন্সি আমার বাবাকে একটু দেখেন। আমরা প্রথমেই বুঝতে পেরেছি যে রোগী আর নাই তারপরও আমরা তাড়াতাড়ি করে ওনার ভাইটাল সাইট গুলো দেখলাম ব্লাড প্রেসার, টেম্পারেচার সব কিছু দেখলাম। উনি বললেন উনার বাবা করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। চারদিন যাবত জ্বর ব্লাড স্যাচুরেশন ৮০ ছিল। তখন তারা অক্সিজেনের ব্যবস্থা বাড়িতেই করেছিলেন। রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হলে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ততক্ষণে রাস্তায় রোগী মারা যায়।

আপনি চিকিৎসা করছেন ক‌রোনা রোগের লক্ষণ দেখছেন হাতের উপর রোগী মারা যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে একজন নার্স হিসেবে আপনি কি পরামর্শ দিবেন।

তিনি বলেন- আমরা করোনার ডিউটি করছি সব ধরনের রোগী দেখছি। কয়েকদিন আগে একজন ৩০ বছর বয়সী রোগী আসে তারও করোনা। প্রচুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এবং অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে বলছে আমার খুব খারাপ অবস্থা আমি কি করবো তখন আমি বললাম ভাই টেনশন করেন না ভালো হয়ে যাবেন। ইয়ং মানুষ তার ডায়াবেটিস নাই তারপরও প্রচুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমরা আশ্বাস দিয়েছি বেশিরভাগ রোগী শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসে। হালকা জ্বর নিয়ে রোগী আসে। যে রোগীরা আসে তাদের বেশিরভাগই শ্বাসকষ্ট প্রচুর নিয়ে আসে , অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। কিছুদিন আগে একজন মহিলা রোগী এসেছিলেন, তার হাজবেন্ড মারা গেছে হয়তোবা তার করোনা ছিল। তারপর থেকে তার অনেক জ্বর হাসপাতালে নিয়ে আসে। প্রচুর শ্বাসকষ্ট জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।

রোগীরা যদি প্রথমে টেস্ট করে পজিটিভ হলেই হাসপাতালে ভর্তি হতো তাহলে হয়তো কিছু ট্রিটমেন্ট নিয়েই ভালো হয়ে যেত। তাহলে কিন্তু এই সমস্যা হত না। দেখা যাচ্ছে যখন প্রচুর শ্বাসকষ্ট হয়, যখন অক্সিজেনের খুব প্রয়োজন পড়ে , যখন হাসপাতালে আসে, তখন দেখা যায় যে রোগীর অবস্থা খারাপ থাকে। নিউমোনিয়া পর্যায়ে চলে যায় তখন রোগীদের লং টাইম হাসপাতালে থাকতে হয় এবং প্রচুর অক্সিজেন তাদেরকে দিতে হয়।

যখন রোগী লং টাইম হাসপাতাল থাকে তখন আপনারা তাদেরকে কি কি ধরনের ওষুধ দেন জানতে চাইলে আশরাফুল বলেন-আমাদের এখানে সব ধরনের ওষুধই বিনা মূল্যে দেয়া হয় । এখানে করোনা রোগী যারা ভর্তি হয় কোন ধরনের ঔষধ তাদের কিনতে হয় না হাসপাতাল থেকেই দেয়া হয়। করোনা রোগীর জ্বর আসে তাদের রেমডেসিভির, ভিটামিন-ডি, সিভিট এবং জিংক ট্যাবলেট দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে স্যালাইন দেওয়া হয়। অনেক করোনা রোগীর দেখা যায় ব্লাড প্রেসার হাই থাকে ডায়াবেটিস থাকে তাদেরকে সেই ট্রিটমেন্ট গুলোও দেওয়া হয়। করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য সব ঔষধ ফ্রি দেওয়া হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে। রেমডিসিভিরের মত অনেক দামী ঔষধও দেওয়া হয়।

একজন নার্স হিসেবে করোনা থেকে বাঁচার জন্য আপনি কি পরামর্শ দিবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন-
এই করোনা থেকে বাঁচার জন্য আমাদের নিরাশ হওয়া যাবে না। মনোবল রাখতে হবে আমরা যেন ভেঙে না পড়ি। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে আমরা যেহেতু সব সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারি না তাই নাকে মুখে স্পর্শ করা উচিত না। মুখে মাস্ক পরা উচিত সবসময়। আরেকটা জিনিস দেখা যাচ্ছে অনেক লোক মাস্ক পরে সেটাকে আবার পকেটে রেখে দেয় পরে আবার সেটাকেই ব্যবহার করছে আবার সেটাকে আশেপাশে ফেলে দিচ্ছে। কিছু লোককে দেখা যায় মাস্ক পরতে চায়না। করোনা রোগীর সামনে বসে আছে আবার তারাই বাইরে গিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। এভাবেই বাংলাদেশে করোনা দ্রুত ছড়াচ্ছে। এইটা আসলে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। যাদের বাসায় হাই ব্লাড প্রেসার ডায়াবেটিস বা টিবি রোগী থাকে তাদের আরো বেশি সচেতন হওয়া উচিত।

আপনাদের হাসপাতালের কোন বয়সী রোগী বেশি আসে জানতে চাইলে আশরাফুল বলেন-বেশীর ভাগ রোগীই বয়োবৃদ্ধ ৭০ বছরের বেশী। পুরুষ রোগী ও বয়স্কদের সংখ্যাই বেশী যেমন ৫০/৬০ বছরের। ৩০/৪০ বছরের সংখ্যাটা কম আর বাচ্চা রোগীর সংখ্যা খুবই কম যেমন ১০/১২ বছরের ২/১ জন রোগী পেয়েছি। তারা চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে চলে গেছে।

জে‌বিন ফেরদৌসি মিশু

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মে‌ডিকেল কলেজ হাসপাতাল

কোভিড-১৯ মহামারীতে আপনারা যারা ফ্রন্ট লাইনে আছেন কেমন করে সময় পার করছেন প্রথমে যখন কোভিড-১৯ শুরু হল তখন সবাই খুব ভয় পেত আপনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ভয়েস অফ আমেরিকা কিছু বলুন-
প্রথম যখন কোভিড-১৯ আসে চীন থেকে সেখানকার ভয়াবহ চিত্র আমরা নিউজের মাধ্যমে জানতে পারি। আমাদের ছোট একটা ওয়ার্ডকে কোভিড-১৯ ওয়ার্ড করে দেয়া হলো পুরো হাসপাতালের মধ্যে। আমরা খুবই ভয়ে ছিলাম। কেউ এখানে ডিউটি করতে চায়নি। আমিও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের ধারণা ছিল করোনা ভাইরাস হলে রিকভারের চান্সটা কম। এরকম একটা ভয়-ভীতি ছিল ওই সময়। এত বেশি মেন্টাল ডিপ্রেশনে ছিলাম যে ফোবিয়াটা খুব কাজ করেছে। কিন্তু প্রথমে যখন কাজ করা শুরু করলাম আস্তে আস্তে ভয়টা কেটে গেছে । এখন আমরা নরমাল রোগীকে যেভাবে দেখছি করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকেও সেভাবে দেখছি। দুই ধরনের রোগীই এখন আমাদের কাছে একই রকম হয়ে গেছে।

জে‌বিন ফেরদৌসি মিশু

প্রথমে যখন আপনি করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সেবা করতে শুরু করলেন তখন আপনার ভিতরে ভয় কাজ করত কি না জানতে চাইলে মিশু বলেন- অনেক ভয় কাজ করত মেন্টাল ডিপ্রেশন ছিল আবার ফিজিক্যালী অনেক প্রবলেম শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমরা যতক্ষণ ওয়ার্ডে থাকতাম পিপিইটা পরে থাকতাম। অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করতাম। ওই সময় আমরা ওয়াশরুম ব্যবহার করতাম না পানিও খেতাম না। তাতে বিভিন্ন ধরনের ডিহাইড্রেশন বেশী হত। আমাদের অধিকাংশ সহকর্মী এই সমস্যায় পড়েছে।

পিপিই পরে থাকতে কষ্ট হতো কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন- পিপিই পরে থাকলে গরমে ঘেমে আমাদের ড্রেস ভিজে যেত। একটা কাপড় ধুয়ে চিপলে যেরকম পানি বের হয় সেরকম ওই ড্রেস থেকেও পানি বের হতো।

প্রথম যেভাবে ড্রেস পরতেন এখনও কি সেভা‌বে ড্রেস প‌রেন কিনা প্রশ্ন কর‌লে মিশু ব‌লেন- হ্যাঁ এখনো ওই ড্রেস পরি। আমরা করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সাথে যতক্ষণ থাকি ততক্ষণ ওভাবেই ডিউটি করি একটানা ১৮ ঘন্টা। একজন রোগী মাস্ক পরতে পারে না ঠিকমতো। তখন রোগীদের অবস্থায় বেশি খারাপ থাকে। আমার কাছে সে সিমপ্যাথি আশা করে। আমার সাথে সে কিছু সময় কথা বলতে চায়। রোগীদের দিক থেকে বেরিয়ার না করে নিজেকে যতোটুকু প্রটেকশনে রাখা যায়। আমার সামনে কোন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শ্বাস নিচ্ছে কিংবা হাঁচি-কাশি দিচ্ছে যার জন্য আমরা এখন প্রটেকশনটা ভালোভাবে নিই আগে যে ভীতি ছিল সেটা এখন আর নাই।

আপনার চোখের সামনেই কোনো রোগী মারা গেছে তখন আপনার কেমন লেগেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন- মারা গেছে অনেক রোগী। কিন্তু তার চেয়েও খারাপ অবস্থা গেছে কিছু কিছু রোগী এমন দেখেছি রাতে ভালো রেখে বাসায় এসেছি সকালে গিয়ে শুনি রোগীটি মারা গেছে।আমরা মেন্টালি প্রিপেয়ার ছিলাম না যে রোগীটা মারা যাবে। তখন খুব খারাপ লাগতো।

আপনাদের হাসপাতলে এখন কতগুলো করোনা ইউনিট আছে জানতে চাইলে মিশু বলেন- শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল পুরোটাই কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল। স্পেশাল কিছু ইউনিট যেমন গাইনি বিভাগ ইমারজেন্সি ওই সব ছোট ছোট বিভাগ ছাড়া পুরোটাই কভিড-১৯ ইউনিট হয়ে গেছে।

প্রতিদিন কি পরিমাণ রোগী আসে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন-প্রথমে ৩০০ বেড ছিল। আমরা নরমাল রোগীদের সার্ভিস দিতাম। এখন করোনা আক্রান্ত রোগীদের এত বেশি চাপ আর এত খারাপ রোগী আসছে তাতে আমাদের হাসপাতলে মোট বেড সংখ্যা ৭০০ থেকে ৮০০ হবে।

যে পরিমাণ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে সেই পরিমাণে কি নার্সের সংখ্যা বাড়ছে জানতে চাইলে মিশু বলেন- আরো কমেছে কারণ আমরা একটানা ১৫ দিন ডিউটি করি আবার ১৫ দিন একটা ব্রেক দিচ্ছি। এই ১৫ দিন ডিউটি করে ২/৩জন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। সেই ২/৩ জন পরের রোস্টারে থাকছে না। তিনজন অসুস্থ হলে, সে জায়গায় একজন ম্যানেজ করা যাচ্ছে। শুধু আমার ওয়া‌র্ডে ঘাটতিটা হচ্ছে তা না সব ওয়া‌র্ডেই ঘাট‌তি হ‌চ্ছে।

এরকম কোন স্মৃ‌তি আছে যেটা আপনা‌কে খুব বেশী কষ্ট দিচ্ছে জানতে চাইলে জবাবে তিনি বলেন-আমি একটা রোগী দেখে‌ছি ওনারা ফিনান‌সিয়ালি অনেক সল‌ভেন্ট। ‌ছে‌লে মে‌য়ে ইস্ট্যাবলিশড কিন্তু ওনার ছে‌লে মেয়েরা ঠিকমত দেখ‌তে আসেনা । লোকটি অনেক সময় অনেক আক্ষেপ করেন। করোনা রোগীর এটেনডেন্টরা রোগীকে যদি ঠিকমত দেখাশোনা করত তাহলে ভালো হতো। আমার একটা দেখা ঘটনা: এক মহিলা তার বাবাকে নিয়ে হাসপাতলে আসলো ১৫ দিন যাবত সেই মহিলা একা একাই অনেক সাফার করলো কিন্তু তার ভাই-বোনেরা কেউ আসলো না । সেটা দেখে আমাদেরও খারাপ লাগতো অনেক সময় দেখা যায় রোগীকে ফেলে তার আপনজনেরা চলেও যায়।

আপনার স্বামী আপনাকে এই কাজে কি রকম সাপোর্ট দেয় জানতে চাইলে মিশু বলেন- আমার স্বামী আমাকে ১০০% সাপোর্ট দেয়। আমার যখন কোভিড -১৯ হয়েছে তখন সে তার চেম্বারের কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিল। যখন সে শুনেছে আমার কোভিড-১৯ হয়েছে সাথে সাথে সে চলে এসেছে। আমি যতদিন অসুস্থ ছিলাম ততদিন সে আমার সাথে ছিল।


এই যে আপনার কোভিড -১৯ পজেটিভ হয় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে অফিসে জয়েন করলেন তখন আপনার ভয় লাগেনি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন-প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। পরে আর ভয় লাগেনি এখন আমার কাছে মনে হয় যে একটা রোগী অসুস্থ একজন মানুষ। তার ভিতরে করেনাভাইরাস আছে এটার দ্বারা অন্য কেউ আক্রান্ত হতে পারে এমন মনে হয় না।

সুমা তালুকদার

রাজাপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

সুমা তালুকদার নার্সিং কোর্স করার পরে যখন সরকারি চাকরি নেন তখন তিনি নিজ জেলার থানা পর্যায়ে পোস্টিং নেন। তিনি বলেন - আমি নার্সিং ডিপ্লোমা করেছি আদদ্বীন উমেন্স কলেজ থেকে আর গ্রাজুয়েশন করেছি ইউনাইটেড কলেজ অব নার্সিং মহাখালী থেকে। নার্স প্রফেশনে মেয়েদের কোটা বেশী ছেলেদের কোটা মাত্র ১০ ভাগ দেওয়া হয়েছে। প্রটেকশন নিয়ে ডিউটি করছি। রোগীর মধ্যে আতঙ্ক থাকে এবং রোগীর আত্মীয় স্বজনরা রোগীর কাছে আসতে চায় না।

করোনা রোগী নিয়ে কাজ করার সময় আপনি ভয় পেতেন কি না জানতে চাইলে সুমা বলেন-আমার মধ্যে ভয় কাজ করেনা। কেননা দেখা গেছে জেনারেল একজন রোগী আসলো ইভনিং শিফটে শ্বাসকষ্টের রোগী তাকে কেনলা পরাই স্যালাইন লাগাই তারপর দেখলাম তার ভাইটাল আনস্টেবল স্যাচুরেশন ফল করছে শরীরে অক্সিজেন লেভেলটা কম। আমি অনেক রোগীর টেস্ট করছি। করোনা কি তা আমি আগে থেকে জানতাম না। রোগীর করোনা টেস্ট করার পর দেখা গেল তার রেজাল্ট পজিটিভ আসছে। তার আগেও তাকে যেভাবে হ্যান্ডেল করা হয়েছে তারপরে তাকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে নেওয়া হয়েছে কিন্তু সে রকম ভয় কাজ করে না।

সুমা তালুকদার

পিপিই প‌রে কাজ করতে কেমন লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন- খুব অস্বস্তি লাগে। আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে এসি নাই। গরমের দিনে পিপিই পরে থাকলে ঘেমে যাই। মাস্ক চেঞ্জ করতে হয় পিপিই চেঞ্জ করতে হয়। আমাদের ইউনিফর্ম ঘেমে ভিজে যায়। আরো সমস্যা আছে একটু যদি নাস্তা করতে চাই তাহলে অনেক প্রিপারেশন নিতে হয়। পিপিই চেঞ্জ করতে হয় হাত ধোয়া লাগে। যদি জরুরি প্রয়োজনে ওয়াশরুমে যেতে চাই তখনও একটা বিশাল প্রবলেম হয়। ওয়াশরুমে যেতে চাইলে পুরোপুরি খুলে ডিসপোজ করে যেতে হবে। কারণ পিপিই খুলে আবার সেটাই পরা যাবে না। আমাদের এখানে অনেকেই সিনিয়র তাদের কোভিড-১৯ রোগীদের ডিউটি কম দেয়া হয়। যদি কোনো গর্ভবতী সহকর্মী থাকে তারাও করোনার ডিউটি করেনা।

করোনার চিকিৎসার ঔষধ সরকারি হাসপাতাল থেকে ফ্রী দেয়ার কথা আপনাদের ওখান থেকে কি দেওয়া হয় না জানতে চাইলে তিনি বলেন- সব ধরনের ঔষধ নাই কিছু কিছু আছে প্রাইমারি লেভেলের যেমন ট্যাবলেটের মধ্যে প্যারাসিটামল, গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ এন্টিবায়োটিক এগুলো আছে। করোনার জন্য যে আলাদা করে ইনজেকশন থাকে সেগুলো নাই। জেনারেল মেডিসিন গুলো আছে।

অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হতেও চায়না। কয়েকদিন আগে ৬০বছর বয়সের একজন রোগী সকালে হাসপাতালে আসলো তার করোনা পজিটিভ হয়েছে বাসায় গিয়ে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিল বিকেলে অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতলে আনতে আনতে ইমারজেন্সিতেই মারা গেল।

অনেক সময় রোগীরা হাসপ্তালে ভর্তি হতে চায়না কেন, জানতে চাইলে সোমা বলেন- যারা একটু সচেতন তারা ভাবে করোনা পজিটিভ হওয়ার পরেও মনে করে হাসপাতলে অনেক রোগী অনেক গেদারিং বেড গুলো খুব কাছাকাছি। এখানে রুমের মধ্যে ৯/১০ জন রোগী তারাও করোনা আক্রান্ত ওই রুমের মধ্যে সবগুলো পুরুষ বেড । সেই ওয়ার্ডের মধ্যেই আমাদের বর্তমানে করোনা রোগী আছে মেল ফিমেল মিলে পঁচিশ জন। প্রতিদিন যে পরিমাণ টেস্ট করা হয় তার মধ্য থেকে প্রায় ৫০% পজিটিভ পাওয়া যায়।

করোনায় আক্রান্ত হওয়া মুমূর্ষু রোগীর কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন- আমি যখন নাইট ডিউটি করছিলাম তখন একটা রোগী এসেছে। ডাক্তার রেফার করেছে বরিশাল নিয়ে যেতে কারণ আমাদের এখানে অক্সিজেন সিলিন্ডার পর্যাপ্ত নাই। তখন আমাদের ২১ জন করোনা রোগী ভর্তি ছিল। আর অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল মাত্র ৪/৫টা। আমাদের তখন কনসেনট্রেটর ছিল না। রোগীকে আমি রিসিভ করি রাত ৮টায় দেখি তার অক্সিজেন লেভেল ৪০% যেখানে সর্বনিম্ন হল ৯০% দরকার। ৯০% হলেই স্বাভাবিক মানুষকে অক্সিজেন দেওয়া দরকার হয়। অন্য ২ জন রোগী খারাপ অবস্থায় আছে এবং ওনারও অবস্থা খারাপ। ওনার বয়স ৬০ বছর হবে। আমরা অনেক অনুরোধ করেছি বরিশাল নেওয়ার জন্য। ওনার অক্সিজেন কন্টিনিউ করা দরকার। রাত আড়াইটার সময় একটি ডেলিভারি করিয়েছি ডেলিভারি বাচ্চার অবস্থাও খারাপ। অক্সিজেনটা খুলে করোনা রোগীর থেকে নিয়ে বাচ্চাটাকে দেওয়া হয়েছে জাস্ট বাচ্চাটা মনে হয় ৫মিনিট অক্সিজেন পেয়েছে এর মধ্যে অক্সিজেন শেষ হয়ে গেছে। এদিকে ওই রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে বাকি অন্য রোগী থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার খুলে এনে লাগিয়েছি। আমি তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে কল দিয়েছি রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিয়েছে কিন্তু উনি রাত সাড়ে চারটার সময় মারা গেছে। এই রোগীর আইসিইউ দরকার ছিল।

উপজেলা লেভেলে আমাদের ওয়ার্ড বয়, ঝাড়ুদার নেই। রাতে রোগীর অক্সিজেন দরকার হলে সিলিন্ডার এনে লাগানো একজন মেয়ে মানুষের জন্য ডিফিকাল্ট। আমার চাকরির পাঁচ বছরে এখানে কোন ওয়ার্ড বয় পাইনি। আমাদের জব ডিসিপ্লিনের বাইরেও অনেক কাজ করতে হয়।