ট্রাম্পের কাছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির প্রত্যাশা

ফাইল- “ হাউ ডি মোদী” অনুষ্ঠানে মোদীর ভাষণের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড অভ্যাগতদের স্বাগত জানাচ্ছেন। এনআরজি স্টেডিয়াম, হিউস্টন , টেক্সাস। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯।

প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যখন তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করছেন, তখন দক্ষিণ এশিয়া নীতির রূপরেখা একটি নতুন আকার ধারণ করছে: ভারত রয়েছে সামনে একেবারে কেন্দ্রস্থলে আর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।

ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রাক্তন পরিচালক যিনি বর্তমানে জন্স হপকিন্সের স্কুল অফ অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যশানাল স্টাডিজের অধ্যাপক জোশুয়া হোয়াইট বলেন, “ ব্যতিক্রমী ভাবে ভারত ছাড়া যা কীনা বিশাল ও বিশিষ্ট, আমার মনে হয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ ওয়াশিংটনের কাছ থেকে কিছুটা কম মনোযোগ আকর্ষণ, ভবিষ্যত্ সম্পর্কে কিছুটা কম বোঝার এবং বহুপাক্ষিক সংগঠনসমূহ কিংবা বহুপাক্ষিক চ্যানেলের মাধ্যমে বেশি করে দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে”।

ভারত

ট্রাম্প প্রশাসনের আঞ্চলিক অগ্রাধিকারের বিষয়টি সোমবার প্রেসিডেন্টের অভিষেকের দিন পরিস্কার হয়ে ওঠে। যেখানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে এ উপলক্ষ্যে তাদের রাষ্ট্রদূতদের পাঠানোর মধ্যেই সীমিত রাখা হয়, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর প্রত্যাশিত প্রথম সারিতেই আসন গ্রহণ করেন।

বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জয়শঙ্কর বলেন,“এটি খুবই পরিস্কার ছিল যে ট্রাম্প প্রশাসন এই অভিষেক অনুষ্ঠানে ভারতের উপস্থিতির বিষয়ে আগ্রহী ছিল। স্পষ্টতই তারা এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিচ্ছে”।

যদিও বাইডেন প্রশাসন প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে, ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনকে আরও সম্প্রসারিত সহযোগিতার সুযোগ হিসেবে দেখছেন। ট্রাম্পের প্রথম আমলে ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যে উষ্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয় তাতে আরও গভীর অংশীদারিত্বের প্রতিশ্রুতি রয়েছে বলে কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

অক্টোবর মাসে ট্রাম্প মোদীকে “এক মহান বন্ধু” এবং “সব চেয়ে চমত্কার মানুষ” বলে অভিহিত করেন। জবাবে তাঁর অভিনন্দন বার্তায় মোদী ট্রাম্পকে “প্রিয় বন্ধু” বলে সম্বোধন করেন এবং“আবার ঘনিষ্ঠ ভাবে একত্রে” কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

এই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্রও বটে যারা এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণে একটা ভারসাম্য আনতে পারে। চীনের পর যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বানিজ্যিক অংশীদার।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যাঁরা উভয়ই চীন বিরোধী এবং ভারতের কড়া সমর্থক, তাঁরা নতুন দিল্লির সঙ্গে আরও গভীর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর জোর দিবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

ভারতের গুরুত্বের কারণেই রুবিও তাঁর প্রথম দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন জয়শঙ্করের সঙ্গে।

ফাইল- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদরে সমাবেশ । লাহোর, পাকিস্তান, জানুয়ারি ০২,২০১৮। (এএফপি)

জয়শঙ্কর বলেন, “এই সম্পর্কের অগ্রযাত্রার জন্য, প্রতিবন্ধকতা অপসারণের জন্য, আরও বড় লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য স্পষ্টতই বড় রকমের চাহিদা রয়েছে”।

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের প্রাথমিক আলোকপাত: নথিপত্রবিহীন ভারতের অভিবাসনপ্রার্থীদের ব্যাপক হারে স্বদেশে প্রত্যাবাসন

ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ভারত এমন ১৮,০০০ কাগজপত্রবিহীন অভিবাসনপ্রার্থী ভারতীয়দের চিহ্নিত করেছে যাদেরকে স্বদেশে ফরিয়ে নেওয়া হবে বলে ব্লুমসবার্গ নিউজ জানিয়েছে।

জয়শঙ্কর বলেন ভারত অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশার বিরোধী এবং অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীদের ফেরত নিতে প্রস্তুত।

তবে দু দেশের সম্পর্কের মধ্যে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তিনি বলেন, ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা পেতে বিলম্ব “জনগণের সঙ্গে জনগণের সংযোগক বাধাগ্রস্ত করেছে”।

তাছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন ট্রাম্প প্রশাসন অন্যান্য ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের মতো ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কটা তখন একটু পিছনে পড়ে যাবে।

পাকিস্তান

ট্রাম্পের অভিষেকের দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ আশাবাদ ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও জোরালো করতে নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় প্রকাশ করেন।

সোমবার এক্স ‘এ শরীফ লেখেন,“এই অঞ্চলে এবং তার বাইরেও আমাদের জনগণের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য আমাদের দু’টি মহান দেশ বহু বছর ধরে একত্রে কাজ করে যাচ্ছে এবং আমরা তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবো”।

পাকিস্তানের একটি শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা ডন শুক্রবার জানিয়েছে যে নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার জন্য ইসলামাবাদ পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নাকভিকে ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক টিমের সদস্য ও কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছে।

তবুও যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক টান টান অবস্থায় রয়েছে। তাঁর প্রথম আমলের গোড়ার দিকে ট্রাম্প পাকিস্তানকে নিরাপত্তা বিষয়ক অধিকাংশ সহায়তা প্রদান এই অভিযোগে স্থগিত করেন যে তারা সন্ত্রাসবাদকে লালন করছে। তারপর তার প্রশাসন যখন আফগানিস্তানের তালিবানের সঙ্গে আপস আলোচনা শুরু করে তখন পাকিস্তানের সঙ্গে আবার ক্রমশ সহযোগিতা শুরু হয়।

ফাইল- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদরে সমাবেশ। লাহোর, পাকিস্তান, জানুয়ারি ০২,২০১৮।

ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির সম্ভাবনাকে জটিল করে তুলেছে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কারাবাস কারণ কংগ্রেসের বহু সদস্য ও ট্রাম্পের কিছু উপদেষ্টা তাঁর মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন।

এই আহ্বানের প্রতি ইঙ্গিত করে পাকিস্তানি পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেন, যদিও তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে আশাবাদ পুনর্ব্যক্ত করেন।

ডন পত্রিকা অনুযায়ী মুখপাত্র শাফকাত আলী খান বলেন,“এটি হচ্ছে সেই নীতির অংশ যার উপর ভিত্তি করে আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক তৈরি হয়”।

পাকিস্তানের একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জামির আকরাম উল্লেখ করেন যে ওয়াশিংটন ইসলামাবাদকে দেখে চীনের সঙ্গে দেশটির কৌশলগত মৈত্রি ও ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার ভিত্তিতে।

ইসলামাবাদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট আয়োজিত এক পডকাস্টে আকরাম বলেন, “সুতরাং এটা একটা কঠিন পরিস্থিতি, আমরা যার সম্মুখীন হবো”।

বাংলাদেশ

দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন কি রকম হবে সে ব্যাপারে আরেকটি জটিলতা রয়েছে বাংলাদেশকে নিয়ে। গত আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার উত্খাতের পর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে বিপুল সমর্থন পেয়েছিল।

সেই সমর্থন এখন খসে পড়ছে। ইউনূস, যিনি অতীতে ট্রাম্পের প্রতি সমালোচনামুখর ছিলেন, এখন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বিষয়ে সতর্ক আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, ইউনূস ট্রাম্পকে পাঠানো তাঁর অভিনন্দন বার্তায়,“এ ব্যাপারে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ব্যক্ত করেন যে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্রগুলি খুঁজে পেতে উভয় দেশই একত্রে কাজ করে যাবে”।

ফাইল- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনের সময়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে বক্তব্য রাখছেন তদানীন্তন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ষ্টিফেন বাইগান।ঢাকা, বাংলাদেশ, অক্টোবর ১৫,২০২০।

দেশটির দু’টি নেতৃস্থানীয় দল -বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও উন্নযনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য জোর দিয়েছেন।

বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন,“আমি আশা করি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমেরিকা ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পক্ষে সমের্থন ও সহযোগিতা প্রদান করবে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশে গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে লালন করতে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করবে”।

তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক উপ-মন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, বাইডেন প্রশাসনের নীতির সমালোচনা করে এখন সেই দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধন করতে বলেন।

আরাফাত, ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন,“দূর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তির প্রতি বাইডেন প্রশাসন অটল সমর্থন জানিয়েছিল, ট্রাম্প প্রশাসন তার বিপরীতে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করেছে, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকছে”।

এই প্রতিবেদনে ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগ অবদান রেখেছে।