রবিবার একটি যাত্রীবাহী বিমান দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিমানবন্দরে সামনের ল্যান্ডিং গিয়ার খুলতে ব্যর্থ হলে রানওয়ে থেকে আছড়ে পড়ে এবং একটি কংক্রিটের ব্যারিকেডে ধাক্কা খেলে বিমানটিতে আগুনে ধরে যায়। বিমানটিতে থাকা ১৮১ জনের বেশিরভাগই দেশটির অন্যতম ভয়াবহ এই বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
জেজু এয়ারের যাত্রীবাহী বিমানটি সোওল থেকে প্রায় ২৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে মুয়ান শহরে অবতরণ করার সময় বিধ্বস্ত হয়। পরিবহন মন্ত্রণালয় বলে, বিমানটি ১৫ বছর পুরনো একটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ জেট, যা ব্যাংকক থেকে ফিরছিল এবং স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩ মিনিটে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
দক্ষিণ কোরিয়ার অগ্নিনির্বাপক সেবা সংস্থা বলে, ৮৪ জন নারী, ৮২ জন পুরুষ এবং আরও ১১ জনসহ, যাদের অবিলম্বে শনাক্ত করা যায়নি, কমপক্ষে ১৭৯ জন মারা গিয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা দুইজনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। তাদের উভয়েই ক্রু সদস্য ছিলেন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা সচেতন এবং তাদের অবস্থা সংকটাপন্ন নয়।
উদ্ধার করা মরদেহের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫৭ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। যাত্রীদের বেশিরভাগই দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক, এর মধ্যে দুইজন থাই নাগরিকও ছিলেন।
অগ্নিনির্বাপক সংস্থা আগুন নিয়ন্ত্রণে ৩২টি ফায়ার ট্রাক এবং বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার মোতায়েন করে। পরিবহন মন্ত্রণালয় অনুসারে প্রায় ১,৫৭০ জন দমকলকর্মী, পুলিশ অফিসার, সৈন্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদেরও ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত দুর্ঘটনার ফুটেজে দেখা যায়, জেজু এয়ারের বিমানটি উচ্চ গতিতে বিমানবন্দরে আছড়ে পড়ে এবং দৃশ্যত সেটির ল্যান্ডিং গিয়ার তখনও বন্ধ ছিল। ফলে, বিমানটি রানওয়ে পার হয়ে বিমানবন্দরের প্রান্তে একটি কংক্রিটের দেওয়ালের সাথে সজোরে ধাক্কা খায় এবং একটি বিস্ফোরণ ঘটে। অন্যান্য স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে বিমানটি থেকে ঘন কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা যায়, বিমানটি আগুনে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন ছিল।
পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পরে বলেন, প্রাথমিক মূল্যায়নে যোগাযোগের তথ্য থেকে জানা গিয়েছে বিমানবন্দর কন্ট্রোল টাওয়ার বিমানটি অবতরণের কিছুক্ষণ আগে একটি পাখির আঘাত সম্পর্কে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিল, এবং পাইলটকে অন্য একটি অঞ্চলে অবতরণের অনুমতি দিয়েছিল। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিমানটি রানওয়ে পেরিয়ে যাওয়ার ঠিক কিছুক্ষণ আগে পাইলট একটি বিপদ সংকেত পাঠান এবং বিমানটি একটি বাফার জোন পেরিয়ে দেয়ালে আঘাত করে।
পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা জু জং-ওয়ান বলেন, কর্মীরা বিমানের ব্ল্যাক বক্সের ফ্লাইট ডেটা এবং ককপিট ভয়েস রেকর্ডার উদ্ধার করেছেন। এগুলো দুর্ঘটনা এবং আগুনের কারণ অনুসন্ধানকারী সরকারী বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করবেন। তিনি বলেন, তদন্তকারীদের তদন্ত শেষ করতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মুয়ান বিমানবন্দরের রানওয়ে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিমানটির যাত্রীদের মধ্যে দুজন থাই নাগরিক ছিলেন। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংথার্ন শিনাওয়াত, সোশ্যাল মিডিয়া মাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। পেতংথার্ন বলেন, তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন।
থাইল্যান্ডের বিমানবন্দরের পরিচালক কেরাতি কিজমানাওয়াত একটি বিবৃতিতে নিশ্চিত করেন, জেজু এয়ারের ফ্লাইট ৭সি ২২১৬ সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর থেকে কোন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ছাড়াই উড্ডয়ন করেছিল, এবং বিমান বা রানওয়ে নিয়ে কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।
জেজু এয়ার একটি বিবৃতিতে দুর্ঘটনাটির জন্য "গম্ভীর দুঃখ প্রকাশ" করে এবং বলে, তারা "দুর্ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।"
একটি টেলিভিশন সংবাদ সম্মেলনে, জেজু এয়ারের সভাপতি কিম ই-বেই, কোম্পানির অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে মাথা নত করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের কাছে ক্ষমা চান এবং বলেন, তিনি এই ঘটনার জন্য "সম্পূর্ণ দায়িত্ব" নিচ্ছেন। কিম জানান, বিমানটির নিয়মিত পরীক্ষার পর কোম্পানি কোনো যান্ত্রিক সমস্যা চিহ্নিত করেনি এবং তিনি ঘটনার কারণ সম্পর্কে সরকারের তদন্তের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করবেন।
মুয়ান বিমানবন্দরের একটি লাউঞ্জে কর্মকর্তারা কয়েকজন নিহতের নাম ঘোষণা করার সময় পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
এটি দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান চলাচলের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয়গুলোর একটি। শেষবার দক্ষিণ কোরিয়া একটি বড় আকারের বিমান দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল ১৯৯৭ সালে, যখন একটি কোরিয়ান এয়ারলাইন বিমান গুয়ামে বিধ্বস্ত হয় এবং ২২৮ জন নিহত হয়। ২০১৩ সালে, এশিয়ানা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান সান ফ্রান্সিসকোতে বিধ্বস্ত হয়, এতে তিনজন নিহত হয় এবং প্রায় ২০০ জন আহত হয়।