দীর্ঘদিনের লৌহমানব শাসক বাশার আল আসাদকে যে সিরীয় বিদ্রোহীরা ক্ষমতাচ্যূত করেছে তারা ১ মার্চ পর্যন্ত দেশ শাসনের জন্য একজন অন্তর্বর্তী সরকারের নাম ঘোষণা করেছে।
দামেস্কে বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দ এবং ক্ষমতাচ্যূত আসাদ সরকারের কর্মকর্তাদের নিয়ে মন্ত্রী পরিষদের এক বৈঠকে মোহাম্মদ আল বশির বলেন, তাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয়। আল বশির সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকাতেই প্রায় অপরিচিত, তিনি এর আগে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র এলাকার প্রশাসন চালাতেন।
বশির বলেন, “ এই বৈঠকের শিরোনাম ছিল সরকারের তত্বাবধানে ফাইল ও প্রতিষ্ঠান হস্তান্তরন”।
তিনি দু’টি পতাকার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন: গৃহযুদ্ধের সবটুকু সময় ধরে আসাদ-বিরোধীরা যে সবুজ, কালো ও সাদা পতাকা উড়িয়েছে এবং কালো অক্ষরে লেখা ইসলামি শপথ সম্বলিত একটি সাদা পতাকা যা সাধারণত সিরিয়ায় সুন্নি ইসলামি যোদ্ধারা উড়িয়ে থাকেন।
রাস্তায় রাস্তায় সশস্ত্র লোকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যাওয়ায় সিরিয়ার রাজধানীতে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। বিদ্রোহীদের ঘনিষ্ঠ সুত্রগুলি বলছে কমান্ডাররা যোদ্ধাদের শহর থেকে সরে যাবার এবং তার পরিবর্তে প্রধান বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল শাম ‘এর সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশ ও অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বাহিনীকে মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছে।
রবিবার আসাদের পদচ্যূত হবার এবং আশ্রয় নেয়ার জন্য রাশিয়ায় তার প্রস্থানের পর এই প্রথমবারের মতো ব্যাংক ও দোকানপাট খুলেছে। যানবাহন রাস্তায় নেমেছে, নির্মাণ কর্মীরা দামেস্ক শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি গোল চত্ত্বর ঠিক করতে এবং রাস্তা পরিচ্ছন্নতাকারীরা রাস্তা পরিস্কার করতে নেমে এসেছেন।
তবে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের চিহ্ন এখনও রয়েছে । ইসরায়েল সিরিয়ার সেনা-ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে । দু সপ্তাহ ধরে বিদ্রোহীদের প্রায় বিদ্যূৎ গতিতে এগিয়ে এসে আসাদকে ক্ষমতাচ্যূত করার পর সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সীমান্ত পেরিয়ে সিরিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক বাহিনী বিহীন অঞ্চলে ইসরায়েল তার বাহিনী এই বলে পাঠায় যে এই বিমান হামলার লক্ষ্য হচ্ছে যাতে অস্ত্রশস্ত্র বৈরিপক্ষের হাতে চলে না যায়। তারা এই খবরটির সত্যতা অস্বীকার করেছে যে তারা বাফার জোনের বাইরে দামেস্কর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করেছে।
আসাদকে বিতাড়িত করেছে যে ইসলামপন্থিরা তাদের নেতা আবু মোহাম্মদ আল-গোলানি, যে সব সাবেক উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নির্যাতন ও যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সংকল্প ব্যক্ত করেছেন।
এক বিবৃতিতে গোলানি বলেন, “যারা উচ্চ পদস্থ সেনা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের যুদ্ধাপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয়ে তথ্য দেবেন, তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে।
তিনি যে হায়াত তাহরির আল শামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার মূল হচ্ছে সিরিয়ার আল ক্বায়দা শাখা এবং বহু পশ্চিমি সরকার এটিকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করছে, যদিও তারা এখন তাদের বাগাড়ম্বর খানিকটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। সিরিয়ায় জাতিসংঘের দূত গেইর পেডারসন, জেনেভায় বলেন, যে সব দল আসাদকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে তারা তাদের উচিৎ হবে “ভালো ভালো কথাকে”বাস্তবে কাজে পরিণত করা।
পেডারসন বলেন, “ তারা একতা এবং সামূহিকতার বাণী পাঠাচ্ছেন,” তিনি আরও বলেন যে আলেপ্পো ও হামায়ও, “ আমরা দেখেছি বাস্তবেও নতুন করে নিশ্চয়তা প্রদানের ব্যাপার”। তবে, “ আমাদের যা দেখতে চাই না , তা হলো ভাল ভাল বিবৃতি এবং আমরা গোড়াতেই যা দেখছি তা হলো এটি বাস্তবে আমাদের সামনের দিনগুলোতে অনুসরণ করা হচ্ছে না”।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এক বিবৃতিতে বলেন, “ যুক্তরাষ্ট্র সিরীয়দের নেতৃত্বে এবং সিরীয়দের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিবর্তনকে তার পূর্ণ সমর্থন সুনিশ্চিত করছে। আর এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অসাম্প্রদায়িক শাসন ব্যবস্থা চালু হওয়া উচিৎ যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করবে”।
ব্লিংকেন বলেন , “ সিরিয়ার জনগণই সিরিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে। সব রাষ্ট্রিই উচিত্ হবে একটি অন্তর্ভুক্তিমুলক স্বচ্ছ প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার এবং বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা”।
সোমবার দিনের শেষে জার্মান সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে জার্মান চ্যান্সালার ওলাফ শোলজ এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রঁ আসাদ আমলের অবসানকে স্বাগত জানান এবং বলেন “ মৌলিক মানবাধিকার ও জাতিগোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার ভিত্তিতে তাঁরা নতুন শাসকদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে প্রস্তুত”।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে শোলজ ও ম্যাক্রঁ সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষা করার গুরুত্বের উপর তাঁরা জোর দেন। গোলান হাইটস’এ সামরিক বাহিনী মুক্ত মধ্যবর্তী এলাকায় ইসরায়েলের সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইসরাযেল বলছে তাদরে নিজেদের নিরাপত্তারজন্য এটির প্রয়োজন।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের দূত পেডারসান বলেন যে বিশ্ব সংস্থাটি ইসরায়েলের গতিবিধির দিকে এবং ইসরায়েল যে সিরীয় অঞ্চলে বোমা ফেলেছে সে সব দিকে নজর রাখছে।
পেডারসন বলেন, “এটা বন্ধ করতে হবে”।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রী গিদিওন সার সোমবার বলেন যে ইসরায়েলি বাহিনী সন্দেহজনক রাসায়নিক অস্ত্রের স্থানে এবং দূর পাল্লার রকেটের স্থানে আঘাত হেনেছে যাতে করে তারা বৈরি ভূমিকা গ্রহণ করতে না পারে।
সৌদি আরব সিরিয়ায় ইসরায়েলের তত্পরতার নিন্দা করে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছে যে তারা আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করছে এবং “নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক অখন্ডতাকে নষ্ট করছে”।
এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ রয়টার্স এবং এএফপি থেকে নেওয়া হয়েছে।