সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ যেভাবে ক্ষমতায় আসেন এবং যে কারণে বিদ্রোহের মুখে পড়েন

বাশার আল-আসাদ (ডানে) প্রেসিডেন্ট মনোনীত হবার পর সিরিয়ার সেনাপ্রধান জেনেরাল আলি এসলানের সাথে সামরিক মহড়া দেখছেন। ফাইল ফটোঃ ১২ জুলাই, ২০০০।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদ রবিবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এতে তার তার প্রায় ১৪ বছর ধরে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ রাখার লড়াইয়ের নাটকীয় সমাপ্তি ঘটিয়েছে। এই সময়ে, তার দেশ একটি নির্মম গৃহযুদ্ধে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যা আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শক্তির জন্য একটি প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।

আসাদের প্রস্থান ২০০০ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম দিনগুলোর থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত একটি চিত্র তুলে ধরে। তখন অনেকেই আশা করেছিলেন যে তিনি তার পিতার তিন দশকের কঠোর শাসনের পরে একজন তরুণ সংস্কারমুখী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন।

মাত্র ৩৪ বছর বয়সী, পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত এই চক্ষু বিশেষজ্ঞ বিনয়ী স্বভাবের একজন বুদ্ধিদীপ্ত প্রযুক্তি-প্রেমী এবং কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন।

কিন্তু, ২০১১ সালের মার্চ মাসে তার শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সম্মুখীন হলে, আসাদ ভিন্নমতকে দমন করার প্রয়াসে তার বাবার নৃশংস কৌশলের দিকে ফিরে যান।

অভ্যুত্থানটি সম্পূর্ণভাবে গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে, তিনি মিত্রদেশ ইরান এবং রাশিয়ার সমর্থনে তার সামরিক বাহিনীকে বিরোধী-নিয়ন্ত্রিত শহরগুলিতে আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন।

বাশারের বাবা হাফেজ আল-আসাদ (সামনে আসনে বসা) কঠোর হাতে প্রায় তিন দশক দেশ শাসন করেন। পারিবারিক ছবিতে, (প্রথম সাড়িতে বসা) হাফেজের স্ত্রী আনিসাহ মাখলুফ এবং হাফেজ আল-আসাদ। দ্বিতীয় সাড়িতে বাঁ দিক থেকে, সবচেয়ে ছোট ছেলে মাহের, বাশার, প্রয়াত বাসেল, প্রয়াত মাজেদ এবং বুশরা।

কয়েক দশকের পারিবারিক শাসনের অবসান

আসাদ ২০০০ সালে ভাগ্যক্রমে ক্ষমতায় আসেন। তার পিতা বাশারের বড় ভাই বাসিলকে উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করছিলেন। কিন্তু ১৯৯৪ সালে, বাসিল দামেস্কে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন।

বাশারকে লন্ডনে তার চক্ষু চিকিৎসার কাজ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়, তাকে সামরিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার নেতৃত্বের যোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে তাকে কর্নেল পদে উন্নীত করা হয় যেন তিনি একদিন শাসন করতে পারেন।

হাফেজ আসাদ ২০০০ সালে মারা গেলে, পার্লামেন্ট দ্রুত প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য বয়স ৪০ থেকে ৩৪-এ নামিয়ে আনে। বাশারের ক্ষমতায় আসা একটি জাতীয় গণভোটের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়, যেখানে তিনি ছিলেন একমাত্র প্রার্থী।

হাফেজ, যিনি আজীবন একজন সামরিক ব্যক্তি ছিলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে দেশটি শাসন করেন। এ সময় তিনি সোভিয়েত ধাঁচের একটি কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভিন্নমতের ওপর এতটাই দমনমূলক শাসন চালান যে সিরিয়ার জনগণ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে রসিকতা করতেও ভয় পেত।

যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সাথে বাশার আল-আসাদ এবং তার স্ত্রী আসমা। ফাইল ফটোঃ ১৬ ডিসেম্বর, ২০০২।

তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল আরব জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ মুছে ফেলা এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের চিত্র তুলে ধরা।

তিনি ইরানে শিয়া ধর্মীয় নেতৃত্বের সাথে একটি জোট গঠন করেন, লেবাননের উপর সিরিয়ার আধিপত্য নিশ্চিত করেন এবং ফিলিস্তিনি ও লেবাননের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেন।

বাশারকে প্রথমে তার কর্তৃত্ববাদী বাবা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হয়।

দীর্ঘ ও পাতলা গঠনের, সামান্য অস্ফুট উচ্চারণসহ, তিনি একজন শান্ত ও ভদ্র আচরণের ব্যক্তি ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তার একমাত্র সরকারী পদ ছিল সিরিয়ান কম্পিউটার সোসাইটির প্রধান। তাঁর স্ত্রী আসমা আল-আখরাস-কে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পরে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন আকর্ষণীয়, স্টাইলিশ এবং ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত।

এই তরুণ দম্পতি পরবর্তীতে তিনজন সন্তানের জন্ম দেন এবং তারা ক্ষমতার আভিজ্ঞান থেকে নিজেদের দূরে রাখতেন বলে মনে হত। তারা দামেস্কের উচ্চবিত্ত আবু রুমানেহ এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতেন, অন্য আরব নেতাদের মতো রাজকীয় প্রাসাদে নয়।

সিরিয়ার উপকূলীয় শহর তারতুসে ঈদ-উল ফিতর এর নামাজের পর বাশার আল-আসাদ লোকজনের সাথে কথা বলছেন। ফাইল ফটোঃ ১৫ জুন, ২০১৮।

ক্ষমতায় আসার পর, শুরুর দিকে আসাদ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেন এবং আরও খোলামেলা আলোচনার অনুমতি দেন। এই "দামেস্ক বসন্তে," বুদ্ধিজীবীদের জন্য স্যালন খোলা হয়, যেখানে সিরিয়ানরা শিল্প, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি নিয়ে এমন মুক্তভাবে আলোচনা করতে পারতেন, যা তার তার পিতার শাসনামলে অসম্ভব হতো।

কিন্তু, ২০০১ সালে ১০০০ জন বুদ্ধিজীবী বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং বৃহত্তর স্বাধীনতার আহ্বান জানিয়ে একটি পাবলিক পিটিশনে স্বাক্ষর করার পরে এবং অন্যরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার চেষ্টা করার পরে, গোয়েন্দা পুলিশ স্যালনগুলিকে বন্ধ করে দেয় এবং কয়েক ডজন অ্যাক্টিভিস্টকে জেলে পাঠিয়ে দেয়।

আরব বসন্তের সময় আসাদ পুরানো জোটের উপর নির্ভর করেন

রাজনৈতিক মুক্তির পরিবর্তে আসাদ অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ শিথিল করেন, বিদেশি ব্যাংকগুলোর পরিচালনার অনুমতি দেন, আমদানির জন্য দরজা খুলে দেন এবং বেসরকারি খাতকে ক্ষমতায়িত করেন। দীর্ঘদিন ধরে মলিনতায় ডুবে থাকা দামেস্ক এবং অন্যান্য শহরগুলোতে শপিং মল, নতুন রেস্তোরাঁ এবং ভোক্তা পণ্যের সমৃদ্ধি দেখা যায়। পর্যটন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, তিনি তার পিতার নির্ধারিত নীতিতে অটল ছিলেন, যা ইরানের সঙ্গে জোট এবং ইসরায়েল কর্তৃক অধিকৃত গোলান মালভূমির সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধারের দাবির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। যদিও বাস্তবে আসাদ কখনও সামরিকভাবে ইসরায়েলের মুখোমুখি হননি।

লেবাননেরসাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরির হত্যার পর ২০০৫ সালে প্রতিবেশী দেশের উপর সিরিয়ার কয়েক দশকের পুরোনো নিয়ন্ত্রণের অবসান হয়, যা তার জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। লেবাননের অনেক মানুষ এই হত্যার জন্য দামেস্ককে অভিযুক্ত করে। ফলে, সিরিয়া দেশটি থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং একটি আমেরিকাপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসে।

তেহরানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেই-এর সাথে বাশার আল-আসাদ। ফটোঃ ৩০ মে, ২০২৪।

একই সময়ে, আরব বিশ্ব দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে - একটি হল, সৌদি আরব এবং মিশরের মতো সুন্নি নেতৃত্বাধীন দেশ যারা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, অন্যটি সিরিয়া এবং শিয়া নেতৃত্বাধীন ইরান, যার হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনি বিদ্রোহীদের সাথে সম্পর্ক।

পুরো সময়জুড়ে, আসাদ তার পিতার মতোই দেশে একই ক্ষমতার ভিত্তির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। সেটি হল তার আলাউয়ি সম্প্রদায় যারা শিয়া ইসলামের অংশ এবং সিরিয় জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ।

তার সরকারের অনেক পদে নিয়োগ পায় তার পিতার শাসনামলে কাজ করা একই পরিবারের তরুণ প্রজন্মর সদস্য। এছাড়া, তার সংস্কারের ফলে সৃষ্ট প্রভাবশালী সুন্নি বণিক পরিবারের সদস্যরা সহ নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সদস্যদেরও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

আসাদ তার নিজের পরিবারকেও বিভিন্ন পদে আনেন। তার ছোট ভাই মাহের প্রেসিডেন্ট গার্ডের নেতৃত্বে ছিলেন এবং বিদ্রোহ দমন করার জন্য সেনা অভিযান চালান।

তাদের বোন বুশরা আসাদের অভ্যন্তরীণ পরিসরে একটি প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর ছিলেন। তার স্বামী, ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আসফ শওকাত তার সাথে ২০১২ সালের একটি বোমা হামলায় নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত কাজ করেন।

বাশার আল-আসাদের পতনের পর নির্বাসনে থাকা সরকার-বিরোধী সিরিয়দের আনন্দঃ এখানে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে দুজন নারী গালে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের পতাকা এঁকে উল্লাস করছেন। ফটোঃ ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪।

বাশারের চাচাতো ভাই রামি মাখলুফ দেশের বৃহত্তম ব্যবসায়ী হয়ে উঠেন এবং একটি আর্থিক সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব দেন। তবে পরবর্তীতে তাদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়, ফলে আসাদ মাখলুফকে সরিয়ে দেন।

আসাদ তার স্ত্রী আসমার উপর ক্রমশ বিভিন্ন মূল ভূমিকা অর্পণ করেন। কিন্তু মে মাসে তিনি লিউকেমিয়ার চিকিৎসাধীন বলে ঘোষণা করেন এবং লাইমলাইট থেকে সড়ে যান।

যখন ২০১১ সালে তিউনিসিয়া এবং মিশরে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং তাদের শাসকদের পতন ঘটায়, আসাদ তার দেশে একই ধরণের ঘটনার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে তার শাসন তার জনগণের সাথে আরও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়ায় পৌঁছানোর পর তার নিরাপত্তা বাহিনী একটি নৃশংস দমন-পীড়ন চালায়। কিন্তু, আসাদ ক্রমাগত তা অস্বীকার করেন যে তিনি জনগণের বিদ্রোহের মুখোমুখি হচ্ছেন। তিনি এর পরিবর্তে তার শাসনব্যবস্থা অস্থিতিশীল করার জন্য "বিদেশী মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের" দোষারোপ করেন।

তার বক্তব্য সিরিয়ার সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে, যেমন খ্রিস্টান, দ্রুজ এবং শিয়া, পাশাপাশি কিছু সুন্নির মধ্যে একটি গভীর প্রভাব ফেলে, যারা আসাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের চেয়ে সুন্নি উগ্রপন্থীদের শাসনকে আরও বিপজ্জনক মনে করতেন।

অভ্যুত্থানটি যখন একটি গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়, লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান জর্ডান, তুরস্ক, ইরাক এবং লেবানন, এমনকি ইউরোপে পালিয়ে যায়।

পরিহাসক্রমে, ২০১১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী বিক্ষোভকারীদের কাছে মিশরের হোসনি মোবারকের পতনের দুই দিন পরে এবং আরব বসন্তের প্রতিবাদের ঢেউ তার দেশে ছড়িয়ে পড়ার কয়েক দিন আগে, আসাদ মিশরীয় নেতার পদত্যাগে অস্বীকৃতি নিয়ে ঠাট্টা করে একটি ইমেইল করেছিলেন।