ধর্মীয় নেতাদের সাথে সংলাপে ড. ইউনূস: 'আমরা সবাই বাংলাদেশি'

ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪।

বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মতপার্থক্য থাকলেও তারা সবাই একটি পরিবার, সবাই বাংলাদেশি।

তিনি বলেন, “আমরা একই পরিবারের সদস্য। আমরা একে অপরের শত্রু নই। আমরা সবাই বাংলাদেশি।”

বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) রাজধানী ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।

দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো হামলা হলে সঠিক তথ্য পেতে ধর্মীয় নেতাদের সহযোগিতা চান তিনি।

ড. ইউনূস বলেন, “আমরা সঠিক তথ্য জানতে চাই এবং সঠিকভাবে তথ্য পাওয়ার প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”

তথ্য সরবরাহকারীরা যাতে কোনো সমস্যায় না পড়েন, সেজন্য কীভাবে নিরাপদে সহজে তথ্য গ্রহণ করা যায়, তা জানতে আলোচনায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান প্রধান উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটতেই পারে, তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

এ ধরনের ঘটনা রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তাৎক্ষণিক প্রতিকার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা এবং বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের মধ্যে তথ্যের ফাঁক রয়েছে।

আলোচনায় অংশ নেন মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মের নেতারা।

রমনার সেন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রালের ফাদার আলবার্ট রোজারিও বলেন, “এই মুহূর্তে আমরা একটা স্পর্শকাতর সময় পার করছি, এই সময়ে আমাদের প্রধান কথা ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।...ইস্কনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে সেই ক্ষত দূর করতে হবে।” সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে জামিন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার পরামর্শও দেন ফাদার আলবার্ট রোজারিও।

রমনা হরিচাঁদ মন্দিরের সহ-সম্পাদক অবিনাশ মিত্র বলেন, "আমরা যারা বাংলাদেশে আছি, আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।...যারা বিভেদ তৈরি করছে, তারা বিদেশে বসে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন। তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করবে, এটা আমরা চাই না।"

বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয় বলেন, “আমরা বলেছি দেশে যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকে। আমরা যেন মিলেমিশে থাকতে পারি। এটা আমাদের ঐতিহ্য সেই মিলেমিশে থাকার ঐতিহ্য যেন বজায় থাকে।"

বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় সম্প্রীতির ‘উজ্জ্বল উদাহরণ’ তৈরি করেছে দাবি করে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আহমদউল্লাহ বলেন, “কোনো প্রপাগান্ডায় আমরা যেন পা না দেই, সবাই যেন ঐক্যবদ্ধ থাকি। এজন্য সবাই কথা বলেছেন।”

সরকার পরিবর্তনের পর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা

এ বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানায়, ৪ অগাস্ট থেকে ২০ অগাস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

ঐক্য পরিষদ তাদের প্রতিবেদনে বলে, ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মধ্যে ৯ জনকে হত্যার ঘটনা আছে। ধর্ষণ/গণধর্ষণ করা হয়েছে ৪ জনকে, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে; বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ৯১৫টি; ৯৫৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে; বসতবাড়ি দখল হয়েছে একটি; এছাড়া, ৩৮টি শারীরিক নির্যাতন এবং ২১টি জমি/ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখলের ঘটনা ঘটেছে।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিয়মিত তার সরকারের উদ্বেগের কথা সংবাদমাধ্যমকে জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, দুই নেতা অন্য বিষয়ের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ বাংলাদেশের সকলের জন্য মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে ৩১ অক্টোবর সামাজিকমাধ্যম এক্স ও ট্রুথ সোশ্যাল-এ এক পোস্টে লেখেন, "আমি হিন্দু, খ্রিস্টান এবং অন্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্বর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই যারা বাংলাদেশে মব দ্বারা আক্রমণ ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে, দেশটি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে।"

তবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ অভিহিত করে বলেছে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের খবর “অতিরঞ্জিত” করে প্রচার করা হচ্ছে।

সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে ১৭ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে ড. ইউনূস বলেন “কয়েকটি ক্ষেত্রে” সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হন, কিন্তু সেগুলো ছিল “রাজনৈতিক।”

“অল্প যে সমস্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক,” ইউনূস তাঁর ভাষণে বলেন। “কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে।”

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের পর ভারত সরকার বাংলাদেশের হিন্দুসহ সকল সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের আহবান জানায়।

তার প্রত্যুত্তরে বাংলাদেশ সরকারের বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয় যে, দিল্লির বক্তব্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

সর্বশেষ ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলার করা এক প্রশ্নের জবাবে ৩ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র জানান, "আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর সহিংসতা ও তাদের প্রতি অসহিষ্ণুতার যেকোনো ঘটনার নিন্দা জানাই এবং বাংলাদেশের সব নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া অব্যাহত পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানাই।"

আরেক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র দফতর জানায়, "যুক্তরাষ্ট্র ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংগঠন (করার স্বাধীনতা কে) মৌলিক স্বাধীনতা হিসেবে সমর্থন করে। আমরা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারসহ আমাদের সকল অংশীদারদের কাছে সেই সমর্থনের কথা জানাই।"