ভিওএ জরিপঃ ভারতকে পছন্দ করেন ৫৩.৬%, অপছন্দ করেন ৪১.৩% বাংলাদেশি

ফাইল ছবিঃ লাল কেল্লায় ভারতের পতাকা উড়ছে।

বাংলাদেশের ৫৩.৬ শতাংশ মানুষ ভারতকে পছন্দ করেন আর দেশ হিসেবে ভারতকে অপছন্দ করেন ৪১.৩ শতাংশ বাংলাদেশি। ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলার এক জনমত জরিপে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

জরিপটির ফলাফল থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে, এবং দেশের মানুষ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দেশ সম্পর্কে ভাল ধারনা পোষণ করেন।

জরিপে ১,০০০ উত্তরদাতাকে কয়েকটি নির্দিষ্ট দেশকে ১ থেকে ৫ স্কেলে ‘ভোট’ দিয়ে তাদের মতামত জানাতে বলা হয়। স্কেলের ১ এবং ২ মিলে হয় ‘পছন্দ’ আর ৪ এবং ৫ মিলে ‘অপছন্দ।’

উত্তরদাতাদের ৫৯ শতাংশ পাকিস্তানকে ‘পছন্দ’ স্কেলে বাছাই করেন। অন্যদিকে, ভারতের ‘পছন্দ’ স্কোর ছিল ৫৩.৬ শতাংশ।

তবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই চরম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ দুটোর মধ্যে ‘অপছন্দ’ স্কেলে বেশ বড় ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, উত্তরদাতাদের ২৮.৫ শতাংশ পাকিস্তানকে ‘অপছন্দ’ করে মত দেন। অন্যদিকে, ভারতের ‘অপছন্দ’ স্কোর ছিল ৪১.৩ শতাংশ।

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে ‘অপছন্দ’ হচ্ছে মিয়ানমার, যা আগে বার্মা নামে পরিচিত ছিল। উত্তরদাতারা মিয়ানমারকে ‘অপছন্দ’ স্কেলে ৫৯.১ শতাংশ এবং ‘পছন্দ’ স্কেলে ২৪.৫ শতাংশ রায় দেয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

অন্যান্য বাছাই করা দেশের মধ্যে, ‘পছন্দ’ স্কেলে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ভোট পায় (৬৮.৪ শতাংশ), যদিও চীন (৬৬ শতাংশ), রাশিয়া (৬৪ শতাংশ) এবং যুক্তরাজ্য (৬২.৭ শতাংশ) বেশি দূরে ছিল না।

অক্টোবরের ১৩ থেকে ২৭ তারিখ, ভয়েস অফ আমেরিকা দেশব্যাপী এই জরিপটি করে।

জরিপটি ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলার এডিটোরিয়াল নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালনা করে গবেষণা ও জরিপ প্রতিষ্ঠান ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড। ভয়েস অফ আমেরিকার ঠিক করে দেয়া সুনির্দিষ্ট (ক্লোজ এন্ড) প্রশ্নমালার উপর ভিত্তি করে কম্পিউটার এসিস্টেড টেলিফোন ইন্টারভিউইং এর মাধ্যমে দেশের আটটি বিভাগে ১৮ বছর বা এর চেয়ে বেশি বয়সী এক হাজার মানুষের মধ্যে জরিপটি পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশের জনতত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জরিপের ১,০০০ উত্তরদাতা বাছাই করা হয়। সেখানে সমান সংখ্যার নারী এবং পুরুষ ছিলেন, যাদের মধ্যে ৯২.৭ শতাংশ ছিলেন মুসলিম। উত্তরদাতাদের অর্ধেকের একটু বেশি ছিল ৩৪ বছর বয়সের নিচে এবং প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহুরে মানুষ।

পড়ুন

ভিওএ বাংলা জরিপঃ কী পদ্ধতিতে জরিপ করা হয়েছে

ধর্ম এবং বয়সের পার্থক্য

ভারত এবং পাকিস্তান সম্পর্কে জরিপে প্রকাশিত মতামতে ধর্মের ভিত্তিতে পার্থক্য দেখা যায়। মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে ৪৪.২ শতাংশ ভারতকে ‘অপছন্দ’ করে মত দেন। অন্যদিকে, অমুসলিম (হিন্দু, ক্রিস্টান ও বৌদ্ধ) উত্তরদাতাদের মাত্র ৪.২ শতাংশ ভারতকে ‘অপছন্দ’ করেন।

তবে মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে দু’দেশের প্রতিই ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে।

ভারতকে ‘পছন্দ’ স্কেলে মত দেন মুসলিম উত্তরদাতাদের ৫০.৭ শতাংশ আর অমুসলিম উত্তরদাতাদের ৯০.১ শতাংশ । পাকিস্তানের পক্ষে ‘পছন্দ’ স্কেলে ভোট দেন মুসলিম উত্তরদাতাদের ৬০.১ শতাংশ আর অমুসলিম উত্তরদাতাদের ৪৪.১ শতাংশ।

বয়স ভেদেও কিছু তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। তরুণদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি ‘পছন্দ’ ভারতের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে পছন্দের স্কেলে পাকিস্তান থেকে ভারত কিছুটা এগিয়ে আছে।

উত্তরদাতাদের মধ্যে যারা ১৮-৩৪ বছরের বয়সী, তাদের ৪৭.৮ শতাংশ ভারতকে ‘পছন্দ’ এবং ৪৯.৩ শতাংশ ‘অপছন্দ’ করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে, ৬২.১ শতাংশ ‘পছন্দ’ এবং ২৬.৮ শতাংশ ‘অপছন্দ’ করেছেন।

তবে ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে যেসব উত্তরদাতা ছিলেন, তাদের মধ্যে ভারতকে ৫৯.৮ শতাংশ ‘পছন্দ’ আর ৩৫ শতাংশ ‘অপছন্দ’ করেছেন। অন্যদিকে, পাকিস্তানকে ‘পছন্দ’ করেছেন ৫৫.৭ শতাংশ এবং ৩০.৫ শতাংশ ‘অপছন্দ’ করেছেন।

বাংলাদেশে নারী ও পুরুষ উভয়েই ভারত এবং পাকিস্তানকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। ফাইল ফটো।

নারী ও পুরুষের মনোভাব

পুরুষ উত্তরদাতাদের মধ্যে ভারতকে ‘পছন্দ’ করেন ৫২ শতাংশ, অন্যদিকে ৬৪.৪ শতাংশ পুরুষ পাকিস্তানকে ‘পছন্দ’ করেন। তবে নারী উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫৫.৩ শতাংশ ভারতকে ‘পছন্দ’ করেন আর ৫৩.২ শতাংশ পাকিস্তানের ‘পছন্দ’ স্কেলে রায় দেন।

নারী ও পুরুষের মধ্যে ভারতকে ‘অপছন্দ’ করার মাত্রা প্রায় সমান ছিল (যথাক্রমে ৪০.৪ এবং ৪২.৩ শতাংশ) অন্যদিকে, পাকিস্তানকে ‘অপছন্দ’ করার মাত্রা নারী ও পুরুষ উত্তরদাতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল (যথাক্রমে ৩০.২ এবং ২৬.৭ শতাংশ)।

শহুরে এবং মফস্বলের উত্তরদাতাদের মনোভাবে খুব একটা পার্থক্য বের হয়ে আসেনি। শহুরেদের মধ্যে ৫০.৪ শতাংশ ভারতকে ‘পছন্দ’ স্কেলে রায় দিয়েছেন, আর পাকিস্তানকে দিয়েছেন ৬৩.৯ শতাংশ। অন্যদিকে, মফস্বলের উত্তরদাতাদের ৫৪.৭ শতাংশ ভারতকে ‘পছন্দ’ করেছেন আর পাকিস্তানকে ‘পছন্দ’ করেছেন ৫৭.৩ শতাংশ।

শহুরে এবং মফস্বলের উত্তরদাতারা প্রায় সমানভাবে ভারতকে ‘অপছন্দের’ স্কেলে রায় দিয়েছেন – যথাক্রমে ৪৩.৬ এবং ৪০.৬ শতাংশ। পাকিস্তানকে ‘অপছন্দের’ স্কেলে ২৬.৭ শতাংশ শহুরে এবং ২৮.৯ শতাংশ গ্রামীণ উত্তরদাতা রায় দিয়েছেন।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত

সার্বিকভাবে, ভারত এবং পাকিস্তান ‘পছন্দ’ স্কেলে প্রায় সমান হলেও, ‘অপছন্দের’ স্কেলে ভারতের পাল্লা বেশি ভারি। এর কারণ হিসেবে অনেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকাকে দায়ী করেন।

গত ৫ অগাস্ট ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব বিভিন্ন গোষ্ঠীর কর্মসূচীতে প্রকাশ পাচ্ছে। দেশের গণমাধ্যমেও আগের তুলনায় বেশি ভারত-বিরোধী বক্তব্য স্থান পাচ্ছে।

ডঃ ইউনূস ভারত সম্পর্কে বাংলদেশের বৈরী মনোভাবের কারণ নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করেছেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধান সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন দিল্লির সাথে ঢাকার সম্পর্ক এখন ‘নিম্ন পর্যায়ে’ পৌঁছেছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দিল্লির ভূমিকা ভারতের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব রেখেছে বলে ধারণা করা হয়। ফাইল ফটো।

তিনি অভিযোগ করেন যে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কে ভারত শুধু একটি দল, আওয়ামী লীগের উপর নির্ভর করেছে।

পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশ যখন ভারতের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ককে মূল্য দেয়, তেমনি নয়াদিল্লিকেও অবশ্যই আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলকে ইসলামপন্থী হিসেবে চিত্রিত করা এবং শেখ হাসিনা ছাড়া দেশ আফগানিস্তানে পরিণত হবে এমন বক্তব্য পরিহার করতে হবে।”

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও জোর দিয়ে বলেন, দিল্লিকে অবশ্যই এই বক্তব্য পরিত্যাগ করতে হবে যে, কেবল হাসিনার নেতৃত্বই দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

“ভারতকে এই আখ্যান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে, সবাই ইসলামপন্থী। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ইসলামপন্থী, আর বাকি সবাই ইসলামপন্থী এবং তারা এই দেশকে আফগানিস্তান বানাবে। আর শেখ হাসিনার কাছেই বাংলাদেশ নিরাপদ। ভারত এই গল্পে মুগ্ধ। ভারতকে এই আখ্যান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্য যেকোনো দেশের মতো বাংলাদেশও আরেকটি প্রতিবেশী,” তিনি বলেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে ভারতের উদ্বেগকে তিনি নাকচ করে দিয়ে বলেন, এটি একটি অজুহাত মাত্র। তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের অবস্থা এত বড় আকারে তুলে ধরার চেষ্টা একটা অজুহাত মাত্র।

শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থান করছেন। ফটোঃ ২৭ মে, ২০২৪।

দিল্লিতে শেখ হাসিনা

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ অগাস্ট থেকেই ভারতে আছেন এবং ভারত সরকার তার জন্য ভিআইপি’র মর্যাদা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশের অনেকের কাছে ‘অবন্ধুসুলভ আচরণ’ বলেই মনে হয়।

গত ১৭ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানান, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতেই আছেন। রাজধানী দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিরাপত্তার কারণে খুব অল্প সময়ের নোটিশে শেখ হাসিনা ভারতে চলে এসেছিলেন, এখনো আছেন।

তবে ভারতে অবস্থান করে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন, এরকম খবর স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়ছে। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়কে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে।

ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস বলেন যে ভারতে হাসিনার উপস্থিতি বাংলাদেশে জল্পনা-কল্পনাকে 'উসকে' দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে কেউই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না, কারণ "আমরা তাকে বিচারের জন্য আবার ফিরিয়ে আনতে চাই।

ড. ইউনূস অভিযোগ করেন যে, শেখ হাসিনা ভারতে থেকে "রাজনৈতিক বক্তব্য" দিচ্ছেন, যেটাকে তিনি 'অবন্ধুত্বসুলভ ইঙ্গিত’ বলে অভিহিত করেন।

"তিনি ভারতে আছেন এবং মাঝে মাঝে কথা বলছেন, যা সমস্যার তৈরি করছে। তিনি যদি চুপ থাকতেন, তাহলে আমরা (বিষয়টি) ভুলে যেতাম; লোকজনও ভুলে যেতেন; কারণ তিনি নিজের জগতে থাকতেন। কিন্তু ভারতে বসে তিনি কথাবার্তা বলছেন ও নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। কেউ এটা পছন্দ করছেন না,” তিনি বলেন।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ। ফাইল ফটো।

বিজেপির ‘বাংলাদেশ কার্ড’

তবে বাংলাদেশে ভারতের প্রতি যে বৈরী মনোভাব বিদ্যমান, সেটা হঠাৎ করেই আসেনি বা অগাস্টের পট পরিবর্তনের কারণে ঘটেনি।

দীর্ঘদিন ধরে ভারতের কিছু রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের অনেক নেতা, দেশের নির্বাচনে বাংলাদেশকে ইস্যু হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাদের অভিযোগ হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন বা ‘অনুপ্রবেশের’ ঘটনা ঘটছে। এ’ধরনের কথা-বার্তা মাঝে-মধ্যে কূটনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করে।

সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঝাড়খণ্ড রাজ্য সফরে গিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন, সেটাকে ‘অত্যন্ত নিন্দনীয়’ আখ্যা দিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে হস্তান্তর করা প্রতিবাদলিপির মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের “গুরুতর সংশয়, গভীর আঘাত ও চরম অসন্তোষের” কথা জানিয়েছে।

ভারতের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, অমিত শাহ ২০ সেপ্টেম্বর ঝারখান্ড রাজ্যে এক নির্বাচনী সভায় হুমকি দেন যে, রাজ্যে বিজেপি সরকার গঠন করার পর “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের” উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হবে।

“আমি আপনাদের সবাইকে আহ্বান করছি, ঝারখান্ডে বিজেপি সরকার গঠন করুন। এবং আমরা প্রতিটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীকে উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করে দেবো,” রাজ্যের সাহেবগঞ্জ জেলার সাঁওতাল পরগনায় এক জনসভায় শাহ’র বক্তব্য উদ্ধৃত করে কলকাতার দ্য টেলিগ্রাফ জানায়।

ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে আসা এ ধরনের মন্তব্য দুই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার চেতনাকে ক্ষুণ্ন করে।

সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর ভূমিকা বাংলাদেশে প্রায় ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ফটোঃ ১৬ অক্টোবর, ২০২৪।

ফেলানির স্মৃতি

সীমান্ত সংক্রান্ত যে বিষয় ভারতের প্রতি বাংলাদেশীদের মনে বড় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা হল সীমান্তে হত্যাকাণ্ড। অবৈধ অনুপ্রবেশ বা চোরাচালানি আটকাতে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ প্রায়ই গুলি ছোঁড়ে। যার ফলে, দু’দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে।

সীমান্ত হত্যার যে ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে তা হল, ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানি হত্যা।

সেদিন ভোরে কিশোরী ফেলানি তার বাবার সাথে কুড়িগ্রাম সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বেয়ে দেশে ফিরছিল। বিএসএফ-এর সৈন্যরা ফেলানিকে কাটাতাঁরের বেড়ার উপড়ে গুলি করে হত্যা করে এবং তার মরদেহ সারাদিন বেড়াতে ঝুলে ছিল ।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, প্রতি বছরই সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে বাংলাদেশী মানুষ মারা যাচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক হিসেবে, ২০১৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত, মোট ১৬৪ জন নিহত হয়।

সীমান্ত হত্যাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্ক ভাল করার ক্ষেত্রে একটি অন্তরায় হিসেবে দেখেন।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা সার্ভিসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন যে, ঘনিষ্ঠ, মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা দু’দেশের লক্ষ্য হলেও, কোন কোন বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

“মাঝে মাঝে কতগুলা প্রশ্ন এসে যায় যেখানে সম্পর্কে একটু চির ধরে। যেমন সীমান্তে গুলি করলো, বাচ্চা মেয়ে মারা গেলো, বাচ্চা ছেলে মারা গেলো, এগুলো মনে কষ্ট দেয়। আমরা মনে করিনা যে ভারতের সরকার ইচ্ছা করে এসব করেছে।

"যে সমস্ত কারণে এসব ঘটে, সেসব কারণগুলো যেন আমরা উৎখাত করতে পারি, যাতে এধরনের ঘটনা না ঘটে,যাতে নিরাপদে মানুষ জীবন নিয়ে চলাফেরা করতে পারে," ভিওএ’কে তিনি বলেন।

গঙ্গা থেকে তিস্তা

অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে অগ্রগতির অভাব বাংলাদেশে উদ্বেগ সৃষ্টি করে যা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী থাকলেও, শুধু মাত্র একটি – গঙ্গা – নিয়ে পানি বণ্টন চুক্তি আছে।

বাংলাদেশ ২০১০ সাল থেকে তিস্তা নদী নিয়ে চুক্তি করার জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে সেখানে কোন অগ্রগতি হয় নি।

গত জুন মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা নিয়ে কোন অগ্রগতি না হওয়ায় বিরোধীদল বিএনপি তার তীব্র সমালোচনা করে।

“আমাদের সমস্যা সমাধানে কোনো চুক্তি সই হয়নি। আমরা তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছি না, আর, এ বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি,” বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩ জুন এক অনুষ্ঠানে বলেন।

অগাস্টে সরকার পরিবর্তনের পর দু’দেশের মধ্যে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ভারত অভিযোগ করেছে যে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তা পাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ সেই দাবী অতিরঞ্জিত খবর বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

সম্প্রতি ইসকনের প্রাক্তন সদস্য এবং সম্মিলিত সনাতনী জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার ঘিরে দু’দেশের বাক-বিতণ্ডা, পতাকা অবমাননার অভিযোগ, ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক ভবনের নিরাপত্তা লঙ্ঘন ইত্যাদি ঘটনা ভিওএ’র জরিপের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরে ঘটে।

পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের উন্নতি

অপরদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে।

প্রাক্তন আওয়ামী লীগ সরকার একাধিকবার জানায়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যাজজ্ঞের জন্য পাকিস্তান ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক শীতল থাকবে। তবে ডঃ ইউনূসের সরকার সেরকম কোন দাবী সামনে আনছে না।

বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ২ সেপ্টেম্বর জানান যে, তার দেশ ১২২ দেশের নাগরিকের জন্য ফি ছাড়া ভিসা দেবে, এবং সেই তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

স্থানীয় গণমধ্যমের খবর অনুযায়ী, তিনি আশা করেন দু’দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান ভ্রমণ শীঘ্রই চালু হবে, যা ২০১৮ সালের পর বন্ধ হয়ে যায়।

গত ১৩ নভেম্বর প্রথমবারের মোট পাকিস্তান থেকে একটি পণ্যবাহী জাহাজ সরাসরি বাংলাদেশে আসে, যেটাকে পর্যবেক্ষকরা ঐতিহাসিক বলে বর্ণনা করেন।

৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ করেন

যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ করেন ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাংলাদেশি। যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের অনুভূতি জানতে চাইলে ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রকে খুব পছন্দ করেন এবং ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ মোটামুটি পছন্দ করেন বলে জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ অপছন্দ কোনোটাই করেন না বলে জানিয়েছেন ৫ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা, ৫ দশমিক ৭ শতাংশ এ ব্যাপারে জানেন না বলেছেন, অপছন্দ করেন বলেছেন ৭ দশমিক ৭ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে খুব অপছন্দ করেন বলেছেন ১২ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা।