দক্ষিণ কোরিয়াঃ রাতভর উত্তেজনায় প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারি উল্টে দিল সংসদ

কোরিয়ার রাজধানী সোলে সামরিক আইন জারির ঘোষণার পর জাতীয় সংসদের দেয়ালে কয়েকজন বিক্ষভকারী। ফটোঃ ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইওল বুধবার সকালে বলেন তিনি আগের রাতে নাটকীয় রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে জারি করা সামরিক আইন শীঘ্রই প্রত্যাহার করবেন। উত্তেজনাপূর্ণ রাতে সৈন্যরা সংসদ ভবন ঘিরে ফেলে এবং আইন প্রণেতারা সামরিক আইন প্রত্যাখ্যান করে ভোট দেয়।

প্রেসিডেন্ট ইয়ুন বলেন যেসকল সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে, এবং মন্ত্রীসভার “সদস্যরা আসার পরই” বৈঠক করে সামরিক আইন আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেয়া হবে।

ইয়ুন মঙ্গলবার রাতে সামরিক আইন জারি করে “রাষ্ট্র বিরোধী” শক্তি নির্মূল করার অঙ্গিকার করেন। বিরোধীদল সংসদ নিয়ন্ত্রণ করে, যাদের সাথে তিনি দ্বন্দ্বে লিপ্ত। তিনি অভিযোগ করেন যে, বিরোধীরা কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল।

তিন ঘণ্টারও কম সময় পর সংসদ সামরিক আইন তুলে নেয়ার পক্ষে ভোট দেয়। সংসদের স্পিকার ওউ ওয়ন শিক সামরিক আইনকে “অকার্যকর” ঘোষণা করেন এবং বলেন যে, আইন প্রণেতারা “জনগণকে সাথে নিয়ে গণতন্ত্র রক্ষা করবে।”

প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপ দেশের ইতিহাসের কর্তৃত্ববাদী নেতাদের সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যে ধরনের নেতৃত্ব ১৯৮০’র দশকের পর আর দেখা যায় নি। বিরোধীদল এবং ইয়ুনের নিজ দলের নেতা এই পদক্ষেপের তাৎক্ষনিক নিন্দা করেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার টেলিভিশনে প্রেসিডেন্ট ইয়ুন-এর সামরিক আইন জারি এবং কয়েক ঘণ্টা পর তা তুলে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। ফটোঃ ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪।

স্পিকার ওউ পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার করার আহ্বান জানানোর পর তাদের সংসদ ভবনের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে দেখা যায়।

উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ৩০০-আসনের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং তাদের নেতা লি জে-মিয়ুং বলেন ইয়ুন আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত দলের আইন প্রণেতারা সংসদের মূল ভবনে অবস্থান করবেন।

ইয়ুনের রক্ষণশীল পিপল পাওয়ার পার্টির প্রধান হান ডং-হুন সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তকে “ভুল” বলে আখ্যায়িত করে “জনগণকে সাথে নিয়ে তা আটকানোর” অঙ্গিকার করেন। লি, যিনি ২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে স্বল্প ব্যবধানে ইয়ুনের কাছে পরাজিত হন, তিনি ইয়ুনের ঘোষণাকে “বেআইনি এবং অসাংবিধানিক” বলে বর্ণনা করেন।

সংসদে ভোটের পর সৈন্যদের দ্রুত চলে যাওয়ার প্রশংসা করেন ওউ। “এমনকি আমাদের সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে দুর্ভাগ্যজনক স্মৃতি থাকা সত্ত্বেও, আমাদের নাগরিকরা নিশ্চয়ই আজকের ঘটনাবলী দেখেছে এবং আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পরিপক্কতা দেখেছে,” ওউ বলেন।

সংবিধানে সামরিক আইন

দক্ষিণ কোরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, “যুদ্ধের সময়, যুদ্ধের মত পরিস্থিতিতে অথবা সেরকম তুলনামূলকভাবে জাতীয় জরুরী পরিস্থিতি” যেখানে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে হতে পারে, তেমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট সামরিক আইন জারি করতে পারেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় সেরকম কোন পরিস্থিতি বিরাজ করছিল কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা লি জে-মিয়ুং সংসদ ভবনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন। ফটোঃ ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪।

সামরিক আইন জারি করা হলে, “বিশেষ পদক্ষেপের” মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা এবং অন্যান্য অধিকার খর্ব করা যায়। আদালতের ক্ষমতাও খর্ব করা সম্ভব।

সংবিধানে আরও বলা আছে, জাতীয় সংসদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সামরিক শাসন তুলে নেয়ার দাবী জানালে প্রেসিডেন্ট সেটা মানতে বাধ্য।

ইয়ুনের ঘোষণার পর দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী ঘোষণা দেয় যে, সংসদ এবং অন্যান্য যেসব রাজনৈতিক সমাবেশ “সামাজিক বিভ্রান্তি” সৃষ্টি করতে পারে, সেগুলো সাসপেন্ড করা হবে, জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদ সংস্থা ইওনহাপ। সামরিক বাহিনী জানায়, কেউ তাদের নির্দেশ লঙ্ঘন করলে তাকে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করা হবে।

হোয়াইট হাউস উদ্বিগ্ন

ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউস বলে যে, যুক্তরাষ্ট্র সোলের ঘটনাবলী নিয়ে “গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।” জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের একজন মুখপাত্র বলেন, সামরিক শাসন জারির ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনকে আগাম কোন তথ্য দেয়া হয়নি, এবং তারা দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছে।

প্রেসিডেন্ট ইয়ুন টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে বলেন যে, সামরিক শাসন দেশকে “ধ্বংসের মুখে পড়া” থেকে “রক্ষা করবে।” তিনি বলেন তিনি “উত্তর কোরিয়াপন্থী শক্তি নির্মূল করবেন এবং সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষা” করবেন।

“আমি যত শীঘ্র সম্ভব রাষ্ট্র-বিরোধী শক্তি নির্মূল করবো এবং দেশকে স্বাভাবিক করবো,” তিনি বলেন। তিনি জনগণকে তাঁর উপর বিশ্বাস রাখতে এবং “কিছু অসুবিধা” সহ্য করার অনুরোধ জানান।

সোলের জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে প্রেসিডেন্ট ইয়ুনের পদত্যাগের দাবীতে বিক্ষোভ। ফটোঃ ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪।

ইয়ুনের রাজনৈতিক সঙ্কট

ইয়ুনের জনপ্রিয়তা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হ্রাস পেয়েছে এবং ২০২২ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে বিরোধীদল-নিয়ন্ত্রিত সংসদে নিজের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে তাঁর বেগ পেতে হয়েছে।

ইয়ুনের দল আগামী বছরের বাজেট নিয়ে উদারপন্থী বিরোধীদের সাথে অচলাবস্থায় পড়ে আছে। বিরোধীরা তিনজন শীর্ষ সরকারী প্রসিকিউটরের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব পাস করার চেষ্টাও করেছে, যার মধ্যে সোল সেন্ট্রাল ডিসট্রিক্ট প্রসিকিউটর’স অফিসের প্রধানও রয়েছেন। রক্ষণশীলরা এই অভিশংসন প্রচেষ্টাকে বিরোধী নেতা লি জে-মিয়ুং-এর বিরুদ্ধে ফৌজদারি তদন্তের প্রতিশোধ হিসেবে দেখছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯৮৭ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ইয়ুনের পদক্ষেপই ছিল প্রথম সামরিক আইন জারি। দেশের শেষ সামরিক আইন জারি হয় ১৯৭৯ সালের অক্টোবর মাসে, সামরিক স্বৈরাচার পার্ক চাং-হি আততায়ীর হাতে নিহত হবার পর।

কোরিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ‘স্টিমসন সেন্টার’স ৩৮ নর্থ’ ওয়েবসাইটে গবেষণা বিশ্লেষক নাতালিয়া স্লাভনেয় বলেন, ইয়ুনের সামরিক আইন জারি ছিল “কোরিয়ার গণতন্ত্রের জন্য গুরুতর পিছু হটা” এবং এটা হয়েছে “তিনি ২০২২ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর অধিকার লঙ্ঘনের একটা ট্রেন্ডের” ধারাবাহিকতায়।

দক্ষিণ কোরিয়ার “রাজনৈতিক বহুত্ববাদের বলিষ্ঠ ইতিহাস আছে এবং তারা গণবিক্ষোভ আর দ্রুত অভিশংসন দিয়ে অভ্যস্ত”, স্লাভনেয় বলেন। উদাহরণ স্বরূপ তিনি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পার্ক গেন-হে’র কথা বলেন। দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্টকে ২০১৭ সালে ঘুষ এবং অন্যান্য অপরাধের জন্য ক্ষমতাচ্যুত করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

'অভিশংসন অনিবার্য'

ভয়েস অফ আমেরিকার উইলিয়াম গালো যোগ দিচ্ছেনঃ এই ঘটনাবলী থেকে ধারনা করা যায় যে, ইয়ুন তাঁর পাঁচ বছর মেয়াদের বাকিটা সম্পন্ন নাও করতে পারেন।

“এটাই ইয়ুন প্রেসিডেন্সির শেষ। ফুল স্টপ,” বলছেন কার্ল ফ্রিডহফ, যিনি শিকাগো কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স-এর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ। “এখন একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর প্রেসিডেন্সি কীভাবে শেষ হবে এবং সেখানে কত সহিংসতা হতে পারে।”

সোল-এর ইওনসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চয় জং-কুন, যিনি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুন-জে-ইন এর অধীনে উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, বলেন যে, ইয়ুনের অভিশংসন এখন “অবশ্যই” অনিবার্য।

“দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র মজবুত এবং অবিচল,” তিনি বলেন। “এটা হচ্ছে একটি প্রজাতন্ত্র যার ভিত্তি হচ্ছে সচেতন এবং সক্রিয় নাগরিকদের সংঘবদ্ধ ক্ষমতা, এবং তারা তাদের মূল্যবোধ রক্ষা করতে প্রস্তুত।”

দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের অন্যতম, এবং সেদেশে ২৮,০০০ আমেরিকান সৈন্য অবস্থান করছে।