ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ায় নিক্ষেপ করলো

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত টেলিগ্রাম চ্যানেলে পোস্ট করা একটি ভিডিও থেকে এই ছবি নেওয়া হয়েছে। নভেম্বর ১৯,২০২৪। ( এপি’র মাধ্যমে টেলিগ্রাম, ল্যাশেন পাইশে)

ইউক্রেন মঙ্গলবার জানিয়েছে যে তারা ভোরের আগেই রাশিয়ার ব্রায়নস্ক অঞ্চলের একটি অস্ত্র গুদামে আঘাত হেনেছে । যুদ্ধরত পক্ষগুলি বলছে যে এই প্রথম এই আক্রমণে মোতায়েন করা যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।

দুই পক্ষই এই আক্রমণের কার্যকারিতা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে । এই আক্রমণের দুই দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের আগেকার নীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে, ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার বিষয়টি অনুমোদন করেন ঠিক যখন ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ১,০০০ দিনে পৌঁছালো।

এক বিবৃতিতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ছয়টি আর্মি ট্যাকটিকাল মিসাইল সিস্টেম বা এটিএসিএমএস রকেট দিয়ে , “ গত রাতে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী ব্রায়ানস্ক অঞ্চলে একটি স্থাপনায় আঘাত হানে”। তবে তাদের বাহিনী পাঁচটিকে গুলি করে ভূপতিত করে এবং ষষ্ঠটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা বলেছে যে বিস্ফোরিত রকেট থেকে পড়া অংশগুলো থেকে একটি সামরিক স্থাপনায় আগুন লেঘে যায় কিন্তু এতে কেউ হতাহত হয়নি।

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর জেনারেল স্টাফ ফেইসবুকে দেয়া এক পোস্টে বলেন যে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে ব্রায়ানস্কে, তাদের বাহিনী “ রুশ দখলদারদের সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র শস্ত্রের গুদামে আগুন লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে”।

বিবৃতিতে বলা হয় এই আক্রমণে “ লক্ষ্যস্থলে ১২ টি সেকেন্ডারি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, তবে এতে এটিএসিএমএস যে ব্যবহার করা হয়েছিল সে কথা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা হয়নি। তবে চলমান তৎপরতা নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউক্রেনের একজন কর্মকর্তা আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহারের কথাটি নিশ্চিত করেছেন।

দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ৩০০ কিলোমিটারের কম। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেন্সকি দীর্ঘ দিন ধরেই রাশিয়ার ভেতরে সামরিক স্থানগুলিতে আক্রমণের জন্য এটি ব্যবহার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন চেয়ে আসছিল। তবে মস্কো ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নেটো সামরিক জোটের মধ্যে প্রায় তিন বছর ধরে চলে আসা সংঘাতের আর কোন উত্তেজনা বাড়তে পারে সেই আশংকায় বাইডেন সেটি থামিয়ে রেখেছিলেন। বিশেষত যখন নেটো সামরিক জোটের চারটি সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে।

কিন্তু বাইডেন তাঁর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটান যখন উত্তর কোরিয়া মস্কোর বাহিনীর সঙ্গে রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে যুদ্ধ করতে রাশিয়ায় প্রায় ১০,০০০ সৈন্য পাঠায়। ইউক্রেন এই অঞ্চলটি আগস্ট মাসে দখল করে এবং এখনও তা নিজের দখলেই রেখেছ।

দুই মাস পর বাইডেনের দায়িত্ব শেষ হচ্ছে এবং এটা এখনো পরিস্কার নয় যে নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থানটি ঠিক কি হবে। ইউক্রেনকে অব্যাহত ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা প্রদানের ব্যাপারে ট্রাম্প সংশয় প্রকাশ করেছেন এই দাবি করে যে তিনি এমনকী দায়িত্ব গ্রহণের আগেই এই যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন তবে তিনি সেটা কি ভাবে করবেন সে সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোন পরিকল্পনার কথা জানান নাই।

এখন যখন ইউক্রেন রাশিয়ায় দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সক্ষমতা অর্জন করেছে তখন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মঙ্গলবার একটি পরিবর্তিত মতধারায় স্বাক্ষর করেছেন যাতে বলা হয়েছে যে পরমাণু শক্তি সম্পন্ন কোন দেশের সহযোগিতায় রাশিয়ার উপর স্বাভাবিক আক্রমণকেও যৌথ আক্রমণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং এর ফলে পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

রাশিয়ার সরকারের মুখপাত্র দ্যমিত্রি পেসকভকে যখন জিজ্ঞেষ করা হয় যে পরিবর্তিত মতধারাটি কি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র অনুমোদনের প্রতিক্রিয়ায় করা হয়েছে , তখন তিনি বলেন এটি “যথাসময়ে” করা হয় এবং পুতিন চেয়েছিলেন “বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে” এটিকে হাল নাগাদ করা হোক।

এর প্রতিক্রিয়ায়, হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র বলেন রাশিয়া যে তারা পারমাণবিক মতধারা হালনাগাদ করছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র বিস্মিত হয়নি কারণ বেশ অনেক সপ্তাহ ধরেই রাশিয়া এ রকম ইঙ্গিত দিয়ে আসছিল। মুখপাত্রটি বলেন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান পরিবর্তনের কোন প্রয়োজনীয়তা দেখছে না।

মুখপাত্রটি বলেন, “ এটি কমবেশি সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন বাগাড়ম্বর যা আমরা গত দুই বছর ধরে দেখে এসেছি”।

রাশিয়ার মতধারায় বলা হয়েছে যে ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান, ড্রোন এবং অন্যান্য উড়ন্ত বাহনের মাধ্যমে ব্যাপক আক্রমণ চালানো হলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।

এতে বলা হয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অ-পারমাণবিক শক্তি সম্পন্ন দেশের আক্রমণে যদি “পারমাণবিক শক্তি সম্পন্ন রাষ্ট্রের সহযোগিতা বা অংশগ্রহণ থাকে” তা হলে সেটিকে,“রাশিয়ার উপর যৌথ আক্রমণ” বলে দেখা হবে, এই সংজ্ঞাটি ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র জোটের সংজ্ঞার সাথে মিলে যায়।

তবে এতে সুনির্দিষ্ট ভাবে এ কথা বলা হয়নি যে অবশ্যই এ ধরণের আক্রমণের পারমাণবিক জবাব দেয়া হবে।

পেসকভ বলেন যে এই হালনাগাদ নীতিমালার লক্ষ্য হচ্ছে সম্ভাব্য শত্রুদের এ কথা বুঝতে দেওয়া যে রাশিয়া কিংবা তার মিত্রদের উপর আক্রমণ করা হলে অনিবার্য ভাবেই তার পাল্টা জবাব দেয়া হবে।

এতে আরও বলা হয়েছে যে মস্কোর মিত্র বেলারুশে অন্য কোন দেশ আক্রমণ করলে রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।

১০০০ দিনের যুদ্ধ

রাশিয়া এবং ইউক্রেন তাদের মধ্যকার যুদ্ধের ১০০০তম দিনে বিবৃতি জারি করেছে যাতে উভয়ই একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করেছে।

ক্রেমলিন বলে কিয়েভের প্রতি পশ্চিমিদের সমর্থন, সামরিক অভিযানে কোন প্রভাব ফেলবে না।

পেসকভ বলেন, “কিয়েভের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকবে”।তিনি আরও বলেন যে পশ্চিমি সহায়তা, “ আমাদের এই অভিযানের ফলাফরে কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না। এটি অব্যাহত আছে এবং তা সম্পন্ন করা হবে”।

এ দিকে ইউক্রেন বলেছে যে তারা রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করা অব্যাহত রাখবে। এই আক্রমণ শুরু হয় ২০২২ সালে।

এক বিবৃতিতে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে, “ ইউক্রেন কখনই দখলদারদের কাছে হার মানবে না, এবং আন্তর্জাতিক আইন লংঘনের জন্য রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে শাস্তি দেওয়া হবে”।

সীমান্তবর্তী সুমি অঞ্চলের হ্লুখিভ শহরের একটি আবাসিক ভবনে রাশিয়ার ড্রোন আঘাত হানার পর উদ্ধারকারীরা কাজ করছে। নভেম্বর ১৯,২০২৪।

ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে রাতের বেলায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সুমি এলাকায় রাশিয়ার ড্রোন হামলায় একজন শিশুসহ আট জন নিহত হয়েছেন বলে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

টেলিগ্রামে ইউক্রেনের জাতীয় পুলিশ বাহিনী জানিয়েছে, সীমান্তবর্তী হ্লুখিভ শহরের একটি আবাসিক ভবনের উপর এই আক্রমণে দু জন শিশুসহ আরও ১২ জন আহত হন।

এই আক্রমণে দুইটি উঁচুতলা ভবন এবং একটি হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আরও লোক থাকতে পারেন।

মঙ্গলবার ইউক্রেনের বিমান বাহিনী জানিয়েছে রাতে রাশিয়া যে ৮৭টি ড্রোন আক্রমণ চালায় তার মধ্যে ৫১টিকে গুলি করে ভুপাতিত করা হয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে কাঁদানে গ্যাস পাওয়া গেছে।

রাসায়নিক অস্ত্র বিষয়ক আন্তর্জাতিক নজরদারি সংগঠন এটা জানানোর পর যে দাঙ্গা প্রতিরোধকারী নিষিদ্ধ সিএস গ্যাস, যা কাঁদানে গ্যাস নামেও পরিচিত তার নমুনা তারা ইউক্রেনের দ্যনিপ্রপেত্রভস্ক অঞ্চলে পেয়েছে মঙ্গলবারই ইউক্রেন এটি বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানায়।

রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সংগঠন বা ওপিসিডব্লিউ’র এই প্রতিবেদন সম্পর্কে রাশিয়া তার কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে সংগঠনটি এই রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের জন্য কাউকে দোষারোপ করেনি।

এএফপি জানিয়েছে কেমিক্যাল ওয়েপনস কনভেনশন সিএসসহ দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেব এ ধরণের রাসায়নিক গ্যাসের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে।

উভয় পক্ষই এই সংঘাতে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য পরস্পরকে অভিযুক্ত করেছে এবং ইউক্রেনের পশ্চিমি মিত্ররা দাবি করছে যে মস্কো নিষিদ্ধ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করেছে।

ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতিতে বলা হয়, “ রাশিয়া যে যুদ্ধক্ষেত্রে নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করছে তাতে আরেকবার প্রমাণিত হয় যে রাশিয়া অব্যাহত ভাবে আন্তর্জাতিক আইনকে অবজ্ঞা করে চলেছে।