লক্ষ লক্ষ ভোটদাতা হ্যারিস ও ট্রাম্পের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে যাচ্ছেন

ক্যালিফোর্নিয়ার সিমি ভ্যালিতে নির্বাচনের দিন একজন ভোটদাতা রোনাল্ড রিগান প্রেসিডেনশিয়াল লাইব্রেরীর নির্বাচনী কেন্দ্রে নিজের ব্যালট ভরছেন। নভেম্বর ৫, ২০২৪।

যুক্তরাষ্ট্রে একজন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য লক্ষ লক্ষ ভোটদাতা মঙ্গলবার তাঁদের ভোটের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নেবেন যে তাঁরা কি ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসকে দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করবেন নাকি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, যিনি ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন তাঁকেই আবার হোয়াইট হাউসে পাঠাবেন।

জরিপে দেখা যাচ্ছে ডেমক্র্যাটিক প্রার্থী হ্যারিস এবং তাঁর রিপাবিলকান প্রতিদ্বন্দ্বি ট্রাম্প উভয়ের মধ্যে গত কয়েক দশকের মধ্যে এটি হচ্ছে সব চেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন। যিনি বিজয়ী হবেন তিনি জানুয়ারি থেকে চার বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন জাতীয় এই নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করছে দেশের মধ্যে সাতটি যে প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজ্য রয়েছে সেই রাজ্যগুলির উপর । জরিপে দেখা যাচ্ছে এই দু জন প্রার্থী পরস্পরের সঙ্গে দুই শতাংশ পয়েন্টের মধ্যে রয়েছেন, যাকে ভোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকেরা বলছেন একেবারে দোদুল্যমান।

গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে পরস্পরের ভোট কতটা কাছাকাছি এবং কত তাড়াতাড়ি ভোট গণনা সম্পন্ন হবে তার উপর নির্ভর করছে যে মঙ্গলবার রাতে কিংবা বুধবার ভোরে সম্ভাব্য বিজয়ীর নাম জানা যাবে কিন্তু চার বছর আগের মতো ফলাফল প্রকাশ হতে কয়েক দিন লেগে যাবে না।

নির্বাচনে যে কোন অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য হ্যারিস এবং ট্রাম্প উভয়ই অভিজ্ঞ আইনজীবিদের প্রস্তুত রেখেছেন । তাঁরা মনে করেন যে কোন অনিয়ম তাদের প্রার্থীকে অসুবিধায় ফেলতে পারে।

ক্যলিফোর্নিয়ায় আমেরিকায় ভোটদাতারা ২০২৪ সালের ভোট দিচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে মঙ্গলবার ভোরেই নির্বাচন শুরু হয়। লোকজন সরকারি কেন্দ্রগুলিতে ,দমকল বাহিনীর স্থাপনায়, গির্জায় এবং অন্যান্য ভোট কেন্দ্রে সমবেত হন। দেশটির ৬ টি টাইম জোন অনুযায়ী আরও পরে ভোটকেন্দ্রগুলিতে ভোট গ্রহণ শুরু হয় এবং দুপুরের আগেই ৫০ টি রাজ্যের সর্বত্রই ভোট গ্রহণ শুরু হয়।

৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প নির্বাচনের দিনের প্রথম দিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজ্য মিশিগানে ছিলেন । তিনি তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযান সম্পন্ন করেন গ্র্যান্ড র‍্যাপিডস’এ । এটি রিপাবলিকান দলের শক্ত ঘাঁটি, এখানেই তিনি ২০১৬ ও ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারিভযান সম্পন্ন করেন।

মধ্যরাতের পর ট্রাম্প তাঁর ভাষণে ঘোষণা করেন, “ আমাদের অবস্থা ভাল। আমাকে বলতে হচ্ছে যে ভোটের হিসেবে আমরা অনেক এগিয়ে আছি”।

ট্রাম্প দ্বন্দ্বমূলক বক্তব্যে বলেন, “ তাদের প্রতারণা করতেই হবে, এবং তারা তা করে, তারা তা ভাল ভাবেই করে”। যেমনটি তাঁর প্রচারাভিযান জুড়ে তিনি হ্যারিসের সমালোচনা করেছেন, তেমনি তিনি হ্যারিসকে উচ্চ মূল্য এবং বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে অভিবাসন প্রার্থীদের প্রবেশ করতে দেওয়ার জন্য দায়ী করেন।

পাম বীচে বারবারা ম্যান্ডেল রিক্রিয়াশান সেন্টারে ভোট প্রদানের পর হেঁটে যাচ্ছেন রিপাবলিকান প্রার্থী , সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও সাবেক ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প । ফ্লোরিডা, নভেম্বর ৫, ২০২৪।

ট্রাম্প মঙ্গলবার সরাসরি তাঁর ভোট দেয়ার পর ফ্লোরিডায় তাঁর মারা লাগো সম্পত্তিতে সারাদিন অতিবাহিত করেন। মঙ্গলবার রাতে তিনি ওয়েস্ট পামবীচে নির্বাচনের ফলাফল দেখার সময়ে অতিথিদের একটি সমাবেশের আয়োজন করতে যাচ্ছেন।

৬০ বছর বয়সী হ্যারিস সোমবার রাতে পূর্বাঞ্চলীয় শহরে তারকাদের সমাবেশে তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান সমাপ্ত করেন । সেখানে পপ শিল্পী লেডি গাগা, সঙ্গীত শিল্পীদের দল এবং এক সময়কার টক শো উপস্থাপক ওপরাহ উইনফ্রে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন।

হ্যারিস তাঁর মন্তব্যে ট্রাম্পের কথা উল্লেখ করেননি, প্রায় ৩০,০০০ সমবেত জনতাকে তিনি বলেন, "যেমনটি আশাবাদ, শক্তি, আনন্দ নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম, তেমনি আজ রাতে আমরা শেষ করছি এটুকু জেনে যে আমরা,জনগণ আমাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করার শক্তি রাখি।

হ্যারিস ওয়াশিংটনের হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে নির্বাচন রাতের সমাবেশে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করেছেন। এটি হচ্ছে ঐতিহাসিক ভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের বিশ্ববিদ্যালয় যেখান থেকে ১৯৮৬ সালে অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। রবিবার হ্যারিস বলেন যে তিনি ডাক যোগে ব্যালটপত্রটি “ এখনই পূর্ণ করেছেন” এবং তা তাঁর নিজের রাজ্য “ক্যালিফোর্নিয়ার পথে”।

ডেমক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস পিটসবার্গে একটি নির্বাচনী প্রচারাভিযান সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছেন। নভেম্বর ৪,২০২৪।

উভয় প্রার্থীই সোমবার পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যে যান । সেখানে ১৯টি ইলেক্টরাল ভোট রয়েছে , প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজ্যগুলির মধ্যে যা সব চেয়ে বেশি। তাঁরা সেখানে কয়েকটি সমাবেশ করেন এবং উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত প্রস্তুতকারী অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু পিটসবার্গে উপস্থিত হন।

ঐতিহাসিক ইস্পাত স্থাপনায় উপস্থিত সমর্থকদের হ্যারিস বলেন, “ গতিটা আমাদের দিকে। আমাদের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে রয়েছে উচ্চাকাঙ্খা এবং আমেরিকান জনগণের স্বপ্ন। আর আমরা জানি এখন আমেরিকায় নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব দেয়ার সময়”।

হ্যারিস আরও বলেন, “ আমাদেরকে শক্ত অবস্থানে সম্পন্ন করতে হবে। ভুল করবেন না, আমরাই জিতবো”।

ট্রাম্প একটি ক্রীড়া স্থাপনায় দেওয়া তাঁর ভাষণে বলেন আরেক মেয়াদের প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর নেতৃত্বে, “ অসাধারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে, যেমনটি বিশ্ব আর কখনও দেখেনি”।

ট্রাম্প দাবি করেন “আপনারা যদি কামালাকে ভোট দেন তা হলে আপনাদের জন্য তা হবে আরও চার বছরের জন্য দূর্ভাগ্য, ব্যর্থতা ও বিপর্যয়। আমাদের দেশ আর কখনও ঘুরে দাঁড়াবে না। আমাকে ভোট দিন । আমি আপনাদের পারিশ্রমিক বাড়াবো, আপনাদের আয় বৃদ্ধি পাবে এবং ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে আমেরিকার প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর জন্য, প্রতিটি মানুষের জন্য কর্মের অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হবে, সম্পদ ও সুযোগ বৃদ্ধি পাবে”।

মঙ্গলবারের নির্বাচনী দিনের আগে আট কোটি তিরিশ লক্ষের বেশি লোক হয় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে অথবা ডাক মারফত ভোট দিয়েছেন।

ওয়েস্ট চেস্টারে প্রশাসনিক দপ্তরে নির্বাচনী কর্মিরা ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ডাক মারফত পাওয়া ব্যালট নিয়ে কাজ করছেন। পেনসিলেভিনয়া, নভেম্বর ৫,২০২৪।

এবার ভোট দেয়ার পর ট্রাম্প সংবাদদাতাদের বলেন, “ এটা যদি অবাধ নির্বাচন হয় , আমিই হবো প্রথম ব্যক্তি যে মেনে নেবে” ফলাফল, তবে এর সংজ্ঞা ঠিক কি সেটা পরিস্কার নয়। ডেমক্র্যাটিক দলের সমালোচকরা বলছেন তাঁরা মনে করছেন ট্রাম্প জয়লাভ না করলে তিনি নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করবেন”।

ট্রাম্প জয়লাভ করলে ১৮৮০ সালে গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের পর তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট যিনি পর পর দু মেয়াদে নির্বাচিত হননি। তিনি হবেন গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রেসিডেন্ট হবেন কারণ ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে তিনি যৌন চলচ্চিত্র শিল্পীকে চুপ করানোর জন্য যে অর্থ দিয়েছিলেন তার জন্য ৩৪ টি অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন এবং নভেম্বরের শেষের দিকে তাঁর শাস্তি হবার কথা।

বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে হ্যারিস দাবি করে আসছেন যে তিনি এই নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অসহায় ব্যক্তি কিন্তু পরের দিকে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং এখন তিনি আশা করছেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট হবেন। নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন প্রথম নারী, প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশধর এবং বারাক ওবামার পর দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ যিনি আমেরিকার নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন।

নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এ দেশের ভোট দাতারা এই দুই প্রার্থীর ব্যাপারে গভীর ভাবে বিভক্ত। প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলি সম্ভাব্য ফলাফলকে কি ভাবে দেখছেন তার উপর ভিত্তি করে এই মূল্যায়ন করা হয়েছে।

হনোলুলু হেইল এ লোকজন এ বছরের সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিতে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। হাওয়াই, নভেম্বর ৫,২০২৪।

শেষ মূহুর্তের ভোটে মনে হচ্ছে হ্যারিস-ট্রাম্প প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজ্যগুলোতে প্রায় সমান সমান অবস্থানে রয়েছেন।

আর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজ্যগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না , নির্ধারিত হয় ইলেক্টরাল ভোট দ্বারা। আর এর ফলে ৫০ টি রাজ্যের প্রতিটি রাজ্যের প্রতিযোগিতায় নির্ধারিত হয়। ৪৮টি রাজ্য তাদের সব ক’টি ইলেক্টরাল ভোট জয়ী প্রার্থীকে দেয় । নেব্রাস্কা ও মেইন তাদের ভোট রাজ্যব্যাপী ও কংগ্রেস ডিস্ট্রিক্ট ভোটের হিসেব যুক্ত করে।

প্রতিটি রাজ্যের ইলেক্টরাল ভোটের সংখ্যা নির্ভর করে ওই রাজ্যের জনসংখ্যার উপর , সুতরাং সব চেয়ে বড় রাজ্য সামগ্রিক ভাবে ভোটে বিজয়ী নির্ধারণ করে । মোট ৫৩৮ ইলেক্টরাল ভোটের মধ্যে বিজয়ীকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ২৭০ টি ইলেক্টরাল ভোট পেতে হবে।

পেনসিলভিনিয়া রাজ্যে ১৯ টি ইলেক্টরাল ভোট খুব গুরুত্বপূর্ণ। আরও দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজ্য জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলাইনায় প্রত্যেকটি রাজ্যের ১৬ টি ইলেক্টরাল ভোট আর মিশিগানের ১৫ টি ইলেক্টরাল ভোট গুরুত্বপূর্ণ।

নির্বাচনী জরিপে দেখা যাচ্ছে হ্যারিস কিংবা ট্রাম্প মোটামুটি ৪৩টি রাজ্যে এগিয়ে থাকছেন যাতে তারা ২০০ টি ইলেক্টরাল ভোট কিংবা বেশি পেতে পারেন । তবে ওই রাজ্যগুলির মধ্যে কোন একটিতে সমস্যা দেখা দিলে , বিজয়ী ঘোষিত হবেন অবশিষ্ট সাতটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজ্যের ভিত্তিতে।