ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার

বাংলাদেশ ছাত্র লীগ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে।

বুধবার (২৩ অক্টোবর) সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকার ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’–এর ক্ষমতাবলে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, "বাংলাদেশের স্বাধীনতা–পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এ সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।"

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র–ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে "উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা করেছেন এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছেন।"

"এ ছাড়া সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে," প্রজ্ঞাপনে বলা হয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, "সরকার ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’–এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং এই আইনের তফসিল-২–এ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামের ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করল। এ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে।"

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল। তার আগেই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল সরকার।

ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ

বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে, যেমন ১৯৫২- র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ১৯৯০-এর স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়লে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হয়।

যেমন, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের কর্মীরা বিশ্বজিত দাস নামক এক ২৪-বছর বয়সী দর্জিকে বিরোধী সন্দেহে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে। পুরো ঘটনা ভিডিওতে ধারণ করা হয় এবং টেলিভিশনে প্রচার করা হয়।

বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের সাত বছর পর ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে শের-এ-বাংলা হলের ভেতরে ছাত্র লীগ কর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করে।

ছাত্রলীগের ইতিহাস

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় সংগঠনটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। উনিশ'শ একাত্তর সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নাম হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সরকার বিরোধী আন্দোলনে বড় একটি ভূমিকা রেখেছিল ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে সংগঠনটি মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগ্রাম করেছিল, এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল।

আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত হয় এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ১৯৫৫ সালে নামকরণ করা হয় আওয়ামী লীগ। তখন মুসলিম ছাত্রলীগের নামেও পরিবর্তন আসে। নাম হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’।

উনিশ'শ বাষট্টি সালের শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ভূমিকা ছিল। বাংলার ছাত্রসমাজ ১৯৬৯ সালে সারাদেশে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে, যা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ঐতিহাসিক এই গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

উনিশ'শ একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা নেতৃত্ব দেয় এবং প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে।