ইউক্রেনে সৈন্য ও অস্ত্র পাঠানোর হুমকি দিল দক্ষিণ কোরিয়া

এক লোক সোওলের রাস্তায় প্রদর্শিত একটি সংবাদপত্র পড়ছে। এর কিছু পাতায় এ রকম অভিযোগের খবর আছে যে উত্তর কোরিয়া ইউক্রেনের সীমান্তসংলগ্ন রাশিয়ায় হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২১ অক্টোবর,২০২৪।

দক্ষিণ কোরিয়া ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর হুমকি দিয়েছে। এর কয়েকদিন আগে গোয়েন্দা সংবাদ প্রকাশ করা হয় যাতে অভিযোগ করা হয়েছে যে রাশিয়ার আক্রমণকে সহায়তা দানের জন্য উত্তর কোরিয়া বিশাল সংখ্যক সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা করছে।

ইয়োনহপ বার্তা সংস্থা মঙ্গলবার প্রেসিডেন্টের দপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার, যার নাম প্রকাশ করা হয়নি, উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে যে দক্ষিণ কোরিয়া ইউক্রেনে “প্রতিরক্ষা ও আক্রমণের জন্য অস্ত্র ” পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করছে।

ইয়োনহপ আরও জানিয়েছে যুদ্ধেক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার কৌশল বিশ্লেষণ করতে এবং আটক উত্তর কোরীয়দের জিজ্ঞাসাবাদে সহায়তার জন্য সোওল সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীর লোকজনকে ইউক্রেনে পাঠাতে পারে।

এক বিবৃতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ রাশিয়া থেকে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের “ অবিলম্বে প্রত্যাহার দাবি করে এবং “পালাক্রমে পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ার” প্রত্যয় প্রকাশ করে তবে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে তা সুনির্দিষ্ট ভাবে জানায়নি।

এই সতর্কতা হচ্ছে সোওলের দেয়া সবচেয়ে কঠোর সতর্ক বার্তা যখন ইউক্রেনের সংঘাতে উত্তর কোরিয়ার গভীর সম্পৃক্ততা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে।

গত সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা জানায় যে ইউক্রেনের যুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যেই বিশেষ বাহিনীর ১৫০০ সৈন্য পাঠিয়েছে এবং তারা একটি বিশেষ বাহিনী থেকে মোট ১২,০০০ সৈন্য মোতায়েনের পরিকল্পনা করছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও নেটো কর্মকর্তারা বলেছেন তারা উত্তর কোরিয়ার সেনা মোতায়েনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারছেন না কিন্তু ইউক্রেনে ব্যবহারের জন্য পিয়ংইয়ং এর গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রদানসহ, উত্তর কোরিয়া- রাশিয়া সামরিক সহযোগিতার নিন্দা করেছে।

পশ্চিমি দেশগুলি বহুদিন ধরেই ইউক্রেনকে সরাসরি অস্ত্র প্রদানের জন্য দক্ষিণ কোরিয়াকে বলে আসছে । দক্ষিণ কোরিয়া অবশ্য এই আশংকায় এই আহ্বানে সাড়া দেয়নি যে এর ফলে সোওলকে লক্ষ্য করে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা আরও সম্প্রসারিত হতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ।

কৌশলগত পরিবর্তন

তবে কোন কোন বিশ্লেষক মনে করেন দক্ষিণ কোরিয়ার কৌশলগত হিসেবটা হয়ত বদলে যাচ্ছে যেহেতু সোওলের সতর্কতা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়া-রাশিয়া সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।

এ বছর আরও আগের দিকে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া শীতল যুদ্ধের সময়কার পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি পূনর্বহাল করে যার ফলে আরও ব্যাপক ভাবে সামরিক সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত হয়।

বিশ্লেষকদের মতে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠিয়ে , উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পাবে, দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য আর্থিক সহযোগিতার নিশ্চয়তা পাবে এবং ভবিষ্যতে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ মহড়া দেয়ার প্রস্তুতি নিবে।

সোওলে এ নিয়ে আশংকা রয়েছে যে পিয়ংইয়ং মস্কোর কাছ থেকে সর্বাধূনিক সামরিক প্রযুক্তি পেতে পারে।

সোওলে কাংকুক ইউনিভার্সিটি অফ ফরেন স্টাডিজের অধ্যাপক মেসন রিচী বলেন, সম্ভবত এই সব উদ্বেগের কারণে ইউক্রেনে উত্তর কোরিয়ার সম্পৃক্ততা নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার এ রকম কড়া প্রতিক্রয়া।

দক্ষিণ কোরিয়ার হিসেব

সোওলের অদূরে ডানকুক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক বেন এনগেল বলেন, ইউক্রেনকে অস্ত্র প্রদানের পেছনে থাকতে পারে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়লের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্র, “ শক্তির মাধ্যমে শান্তি” ।

তিনি বলেন, “ তারা যদি কোন রকম প্রতিক্রিয়া না দেখায় তা হলে তাদেরকে খুব শক্তিশালী মনে হবে না । আর ইউক্রেনে অর্থ পাঠানোতো কার্যত তারা করছেই। কাজেই এটি হচ্ছে প্রদর্শনের সহজ পদক্ষেপ”।

দক্ষিণ কোরিয়া এ পর্যন্ত কেবল মাত্র তৃতীয় পক্ষ যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও পোল্যান্ডকে অস্ত্র দিয়েছে যারা সরাসরি ইউক্রেনকে অস্ত্র দিচ্ছে।

তাদের এই অবস্থানকে কর্মকর্তারা এই বলে সমর্থন করেন যে অভ্যন্তরীন আইনে সংঘাতময় এলাকায় অস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে বিধিনিষেধ রয়েছে , যদিও ইয়ুন এমন আভাসো দিয়েছেন যে এই বাধাগুলি পাশ কাটানো যায়।

কিম, যিনি ইউক্রেন যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পৃক্ততার বিরোধীতা করেন , বলেন তিনি শিগগিরই এমন আইন চালু করবেন যাতে এই তৎপরতা বন্ধ করা যায়।

কোন কোন জনমত জরিপে এমন আভাস দেয়া হয়েছে যে দক্ষিণ কোরিয়ার অধিকাংশ অধিবাসীই ইউক্রেনকে অস্ত্র প্রদানের ইবরোধীতা করেন যদিও এ বিষয় সাধারণের মধ্যে বড় রকমের একান বিতর্কের জন্ম দেয়নি।

কোন কোন বিশ্লেষক বলছেন দক্ষিণ কোরিয়া কোন রকম চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর দিবে – বিশেষত যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন যে তিনি ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন কমাবেন।

সোওলের ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কূটনৈতিক গবেষণার অধ্যাপক জেফ্রি রবার্টসন বলেন, “ ট্রাম্প যদি এই নির্বাচনে জয়লাভ করেন , তা হলে বাইডেন ও নেটো ছয় মাস আগে যে আবেদন জানিয়েছিলেন তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়ার কোন অর্থ হয় না।

দীর্ঘ মেয়াদি প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের মতো রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াও কোন কোন বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে দিয়েছেন যে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে কৌশলগত সম্পৃক্ততা গভীর হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘ মেয়াদি চ্যালেঞ্জ দেখা গেছে।

কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ইউনিফেকাশানে রাশিয়া বিষয়ক গবেষক হিউন সেআং সু বলেন যে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক স্বল্প মেয়াদি সামরিক সহযোগিতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

হিউন বলেন, “ লোকজন মনে করেন যে উত্তর কোরিয়া কেবল কিছু সৈন্য পাঠাবে আর এর বদলে অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাবে এবং কিছু সামরিক প্রযুক্তি লাভ করবে। কিন্তু কিম জং ঊনের চিন্তাধারা এর চেয়ে অনেক বেশি”।

তিনি বলেন, “উত্তর কোরিয়ার জন্য রাশিয়ায় যুদ্ধ করা কেবল রাশিয়াকে সাহায্য করা নয়, এটিকে তারা দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার নিজস্ব পবিত্র যুদ্ধ হিসেবে। তাদের মনের কথা এমন হতে পারে যে তারা রাশিয়ার সঙ্গে একত্রে বাঁচবে, লড়াই করবে এবং মরে যাবে”।

হিউন সতর্ক করে দেন যে এই ব্যাপক জোট দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।

হিউন আরও বলেন, “ মোতায়েন করা সৈন্যদের সংখ্যা হয়ত কম হতে পারে, এই ধরণের সৈন্য মোতায়েনের তাৎপর্যটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার কর্ম তৎপরতা বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক মানচিত্রকে পাল্টে ফেলতে পারে”।