শেখ হাসিনার পদত্যাগ বিতর্ক: আমরা যা জানি

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করা নিয়ে ‘বিতর্ক’ আবারও সামনে এসেছে।

মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী পত্রিকার রাজনৈতিক ম্যাগাজিন সংস্করণ জনতার চোখ- এ শনিবার (১৯ অক্টোবর) একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।

প্রতিবেদনে তিনি দাবি করেন তার সাথে আলাপচারিতায় রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন বলেছেন, রাষ্ট্রপতি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে অনলাইনে ও অফলাইনে বিতর্ক অব্যাহত আছে।

সোমবার (২১ অক্টোবর) রাষ্ট্রপতির প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগকে ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে একটি মিডিয়ায় প্রচারণার ফলে হাসিনার চলে যাওয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাষ্ট্রপতি স্পষ্ট করে বলেছেন, পদত্যাগ এবং দেশ ত্যাগ সম্পর্কিত সমস্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলো- ছাত্র-জনতার নেতৃত্বাধীন বিপ্লবে প্ররোচিত - বিশেষ রেফারেন্স নম্বর ০১/২০২৪-এ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমনটি ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বর্ণিত হয়েছে।

রায়ে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও আলোচনা করা হয়।

সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এসব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়েছেন, যা আপিল বিভাগ যথাযথভাবে সরবরাহ করেছেন।

এসব ঘটনার আলোকে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন সব পক্ষকে এই বিষয়টির সমাধানের প্রতি সম্মান জানাতে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল বা বিব্রত করতে পারে এমন কাজ এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ঐক্যের এই আহ্বানের লক্ষ্য দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন

মতিউর রহমান চৌধুরীকে কী বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন

উনি তো কিছুই বলে গেলেন না... শীর্ষক প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের সাথে কথোপকথনের কথা উল্লেখ করেন মতিউর রহমান চৌধুরী।

প্রতিবেদনে মতিউর রহমান লেখেন, "প্রশ্ন করলাম আপনার কাছে কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রটা আছে? আমি শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি। ৫ই আগস্ট সকাল সাড়ে দশটায় বঙ্গভবনে ফোন এলো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে। বলা হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে আসবেন মহামান্য প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। এটা শুনেই প্রস্তুতি শুরু হলো বঙ্গভবনে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফোন এলো তিনি আসছেন না।

চারদিকে অস্থিরতার খবর। কী হতে যাচ্ছে জানি না। আমি তো গুজবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারি না। তাই সামরিক সচিব জেনারেল আদিলকে বললাম খোঁজ নিতে। তার কাছেও কোনো খবর নেই। আমরা অপেক্ষা করছি। টেলিভিশনের স্ক্রলও দেখছি। কোথাও কোনো খবর নেই। এক পর্যায়ে শুনলাম, তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমাকে কিছুই বলে গেলেন না। যা সত্য তাই আপনাকে বললাম। যাই হোক, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কি না? একই জবাব। শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় সে সময় পাননি জানানোর। সব কিছু যখন নিয়ন্ত্রণে এলো তখন একদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এলেন পদত্যাগপত্রের কপি সংগ্রহ করতে। তাকে বললাম, আমিও খুঁজছি।

এ নিয়ে আর বিতর্কের কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী চলে গেছেন এটাই সত্য। তারপরও কখনো যাতে এ প্রশ্ন না উঠে সে জন্য সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়েছি।"

রাষ্ট্রপতি 'মিথ্যাচার' করছেনঃ আসিফ নজরুল

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্র পাননি বলে রাষ্ট্রপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা 'মিথ্যাচার' বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। রাষ্ট্রপতি এই ধরণের বক্তব্য তার শপথ লঙ্ঘনের শামিল বলেও মনে করেন আইন উপদেষ্টা।

সোমবার (২১ অগাস্ট) সাংবাদিকদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া উপদেশের একটি কপি দেখিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, “সেই মতামতের প্রথম লাইনটি হচ্ছে- দেশের বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন...এই রেফারেন্সে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের সব বিচারকের স্বাক্ষর আছে। সেখানে তারা যে মতামত দিয়েছেন, প্রথম লাইনে আছে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন।”

আসিফ নজরুল বলেন, “আমরা মন্ত্রণালয় থেকে একটি নোট রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠাই। সেই নোটটি রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেন, সেখানে তিনি স্বাক্ষর গ্রহণ দেন (রাষ্ট্রপতি দেওয়ার স্বাক্ষরের কপিটিও সংবাদ মাধ্যমে দেখান আইন উপদেষ্টা)। এরপর তিনি নিজেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন।”

ড. আসিফ নজরুল

আসিফ নজরুল দাবি করেন, “৫ আগষ্ট নিজের ভাষণে রাষ্ট্রপতি নিজেই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তিনি নিজেই গ্রহণ করেছেন। তারপর একের পর এক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি সুস্পষ্টভাবে জাতির কাছে প্রমাণিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তিনি নিজেই তা গ্রহণ করেছেন। আজকে আড়াই মাস পরে তিনি যদি বলেন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ দেননি তাহলে এটা এক ধরণের স্ববিরোধীতা হয়। এতে উনার শপথ লঙ্ঘন হয়। এই পদে উনার থাকার যোগ্যতা আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আসে।”

শেখ হাসিনা পদত্যাগ পত্র পাননি-এই বক্তব্যে অটল থাকলে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ হতে পারে এমন ইঙ্গিত দেন আইন উপদেষ্টা।

৫ অগাস্ট রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে কী বলেছিলেন

ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চলে গেলে ওইদিন রাত ১১ টা ২০ মিনিটে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিভিশন বিটিভিতে সরাসরি প্রচারিত ভাষণের শুরুতে রাষ্ট্রপতি বলেন, ''প্রিয় দেশবাসী, আপনারা জানেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।''

তিনি আরও বলেন, ''প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বঙ্গভবনে তিন বাহিনীর প্রধান এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি; বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কের সঙ্গে আলোচনা হয়। শুরুতে সেনা প্রধান বিরজমান সার্বিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তার আলোচনার সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। জরুরি ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।''

এছাড়া গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে বলেও রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে উল্লেখ করেন।

৫ অগাস্ট বিকালে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে শপথ পাঠ করাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের স্পেশাল রেফারেন্স

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চাওয়া হয় রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে।

তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের সাত জন বিচারপতি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পক্ষে মতামত দিয়ে স্পেশাল রেফারেন্স প্রদান করেন।

স্পেশাল রেফারেন্সে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি বলেন, "দেশের বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিগত ৬ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) অনুসারে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করা সম্ভবপর নয়।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ হতে ৮ আগস্ট ১০.০০.০০০০.১২৭,৯৯.০০৭.২০.৪৭৫ নং স্মারকে প্রেরিত পত্রে বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত যাচাই করা হয়েছে।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কোনো বিধান না থাকায় উল্লিখিত প্রশ্নের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত উপদেষ্টা মূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই মতামত প্রদান করছে যে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে জরুরি প্রয়োজনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনার নিমিত্ত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করতে পারবেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি উক্তরূপে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাগণ কে শপথ পাঠ করাতে পারবেন।"

সজীব ওয়াজেদ জয়

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি বলে দাবি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদের

৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ত্যাগের পর বিভিন্ন সময় তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দাবি করেছেন তার মা আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি।

১১ অগাস্ট ভারতের বেশ কিছু গণমাধ্যম ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার একটি বার্তা তাদের হাতে এসেছে বলে দাবি করে। তারা জানায়, সেই বার্তায় আন্দোলন ও পদত্যাগ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছেন, “আমি পদত্যাগ করেছি যাতে আমাকে লাশের মিছিল দেখতে না হয়। তারা আপনাদের (ছাত্রদের) লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল, আমি তা করতে দেইনি। আমি ক্ষমতা ছেড়ে এসেছি।”

ভারতীয় গণমাধ্যমে ঐ প্রতিবেদনে প্রকাশের পর ঐদিনই ওয়াশিংটন সময় দূপুরে সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, "সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত আমার মায়ের পদত্যাগের বিবৃতি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমি তার কাছ থেকে নিশ্চিত হয়েছি যে তিনি ঢাকা ছাড়ার আগে বা পরে কোনো বক্তব্য দেননি।"

১০ আগস্ট বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাথে ওয়াশিংটন থেকে কথা বলার সময়ও শেখ হাসিনা এই সপ্তাহে ভারতে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেননি বলে দাবী করেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ।

রয়টার্সকে তিনি বলেন, "আমার মা কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি। তিনি সময় পাননি।...সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।"

সামাজিক মাধ্যমে শেখ হাসিনা'র 'পদত্যাগ পত্র'

সেপ্টেম্বর মাসে সামাজিক মাধ্যমে শেখ হাসিনার একটি 'পদত্যাগ পত্র' ছড়িয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে সেসময় রাষ্ট্রপতির সহকারী প্রেস সচিব এস এম রাহাত হাসনাত ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের যে পত্রটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সেটি আমরা দেখেছি। কিন্তু সেই পত্রটিতে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় কোনোও সিল,স্বাক্ষর নেই। এটি যে রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেছে, সেই রকমও কিছু নেই এই পত্রটিতে। সুতরাং এটি নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।”

এই পদত্যাগ পত্র প্রসঙ্গে সেসময় জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো: মোখলেস উর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “এই মন্ত্রণালয়ে আমি জয়েন করেছি মাত্র ২০ দিন আগে। সুতরাং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ার বিষয়টি আমি জানি না। এই ব্যাপারে কেউ আমাকে কিছু জানায়নি।"

সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়ে এখনও কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এবিষয়ে এই প্রতিবেদন তৈরির আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাথে আবারো যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা ফোন ধরেননি।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ভবন

আইনজ্ঞরা কী বলছেন

রাষ্ট্রপতি সংবিধান সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর শেখ হাসিনার সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার সুযোগ নেই বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। তাছাড়া শেখ হাসিনা এখন প্রধানমন্ত্রী আছেন এমন বক্তব্যেরও কোনো আইনগত ভিত্তি নেই বলে মনে করেন তারা।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে সিনিয়র অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছে, মন্ত্রী পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এরপর কিভাবে একজন প্রধানমন্ত্রী থাকে। সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর সংবিধানের অনুযায়ী আগের সবকিছুই বাতিল হয়ে গেছে।"

একইভাবে সিনিয়র অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "যেহেতু রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন এবং রাষ্ট্রপতি নিজেই যখন বলেছেন-প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তখন এসব বিতর্ক অর্থহীন।"

সুব্রত চৌধুরী আরও বলেন, “রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিলে আরও কিছুই থাকে না। একমাত্র সংসদের স্পিকার থাকে পরবর্তী সংসদ না আসা পর্যন্ত। এখন তো স্পিকারও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকার অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে দায়িত্ব দিয়েছিল শপথ পাঠ করানোর জন্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখন আগামী নির্বাচন যখন হবে, তখন ওই সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা নিজেরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে একজনকে দায়িত্ব দিবেন শপথ পাঠ করানোর জন্য।"

ওদিকে “সাংবিধানিকভাবে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর আছে, এটা তিনি নিজেই দাবি করেছেন তারও সুনির্দিষ্ট কোনো আইনগত প্রমাণ নেই,” বলে উল্লেখ করেন অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম।

“রাষ্ট্রপতি যখন অবিসংবাদিত ভাবে সংসদ বিলুপ্ত করেছেন এবং তখন শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়ে প্রজ্ঞাপনের প্রয়োজন নেই” বলে যোগ করেন আহসানুল করিম।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন

রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তার অপসারণের দাবি উঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে।

সোমবার (২১ অক্টোবর) রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় জড়িতদের বিচার ও ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের উদ্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, "এখনো সময় আছে, বঙ্গভবনের বিলাসিতা ছেড়ে আপনি আপনার নিজের রাস্তা দেখে নিন।"

মঙ্গলবারের মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বিষয়ে কর্মসূচি দেয়া হবে বলে সোমবার (২১ অক্টোবর) জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ।

এছাড়া রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের দাবিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কক্সবাজারসহ কয়েক স্থানে বিক্ষোভ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

(এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ ইউএনবি থেকে নেয়া হয়েছে।)