শারদীয় দুর্গাপূজাঃ উদ্বেগ ও আশঙ্কার মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব

ফাইল ছবিঃ দুর্গাপূজা

উদ্বেগ ও আশঙ্কার মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা৷ গত কয়েকদিনে দেশের নানা স্থানে মণ্ডপে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনার রিপোর্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি আবারো আলোচনায় এসেছে।

মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) রাজবাড়ী জেলা শহরে সজ্জনকান্দা জেলা সড়ক পরিবহন মালিক ঐক্য পরিষদ মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে দুর্বৃত্তরা মন্দিরের ভেতর ঢুকে দুর্গাপূজা মণ্ডপের পাঁচটি প্রতিমার মুখের কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলে।

রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার শামিমা পারভীন জানিয়েছেন, খবর পেয়ে পুলিশ সেদিন বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।

রাজবাড়ীর ঘটনাই বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের সর্বসাম্প্রতিক খবর।

বিগত কয়েকদিনে কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ফরিদপুরে দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে৷ এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্গাপূজা উদযাপন নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে৷

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ দাবি করেছে শারদীয় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে গত ১৫ দিনে বাংলাদেশে ১৯টি পূজামণ্ডপে ভাঙচুর হয়েছে।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রানাদাশ গুপ্ত ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “শারদীয় দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে গত ১৫ দিনে দেশের ১৪ টি জেলায় ১৯টি পূজামণ্ডপে পূজোর প্রতিমাগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে।”

এবারের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের ভয়, আতঙ্ক ও মানসিক ট্রমার মধ্যে আছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত ভয়েস অফ আমেরিকাকে “দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুর হচ্ছে” উল্লেখ করে বলেন, "সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তো একটা ট্রমার মধ্যে আছে। তারা পূজা করতেও চায়, আবার করতে গেলে হামলার আশঙ্কা মধ্যেও আছে। এখন তারা দোটানায় মধ্যে আছে।”

“এবার পূজা কতটা উৎসবমুখর হবে (তা) বলতে পারবো না। তবে, পূজাকে কেন্দ্র করে ভয় এবং আতঙ্কে আছে সংখ্যালঘুরা” বলে যোগ করেন রানা দাশগুপ্ত।

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত

পূজা মণ্ডপে হামলা বা প্রতিমা ভাঙচুর বাংলাদেশের জন্য কোন নতুন ঘটনা নয়।

সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর থেকে পূজামণ্ডপে হামলার বিষয়টি দেখে আসছি। ১৯৭২ সালে প্রথম দুর্গা প্রতিমার উপর হামলা হয়েছে চট্রগ্রাম এবং ঢাকায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত শত-শত ঘটনা ঘটেছে। কোনটির বিচার পাওয়া যায়নি এবং আসামিদের চিহ্নিত করা হয়নি।”

২০২১ সালে দুর্গাপূজায় কুমিল্লার একটি মণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অন্তত ১৫টি জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে, ভাঙচুর করা হয় শতাধিক মণ্ডপ ও হিন্দুদের বাড়িঘর।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী- ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ঘটনা ঘটেছে ১২ টি। ১৭ টি মন্দিরে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়েছে। আহত হয়েছে ৫ জন। ৩টি হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়েছে।

২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী- হিন্দু সনাতন ধর্মালম্বী বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ২২ টি। এসব ঘটনায় ৪৩টি বিগ্রহ-মূর্তির উপর হামলা হয়েছে। বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে ৫টি। আহত হয়েছে ১৯ জন।

২০২১ সালের ঘটনায় মামলার প্রসঙ্গ টেনে সুব্রত চৌধুরী বলেন, "এখানে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চরমভাবে ব্যর্থ এবং বিচারবিভাগও এই ধরণের ঘটনায় সঠিকভাবে বিচার করতে অনীহা দেখেছি।”

হামলাকারীদের বিচার না হওয়ার কারণে প্রতি বছর পূজামণ্ডপে হামলা হয় বলে মন্তব্য করেছেন রানা দাশগুপ্ত।

পূজা মণ্ডপে নিরাপত্তা জোরদারের উদ্যোগ সরকারের

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শনিবার (৫ অক্টোবর) জানিয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

দুর্গাপূজা উদযাপনে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

উদযাপনকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও ভিডিপি মোতায়েন থাকবে।

দুর্গাপূজার আগে দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে ৩১ হাজার পূজামণ্ডপে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলে সোমবার (৭ অক্টোবর) জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান, মোহাম্মদ ময়নুল ইসলাম।

এবছর বাংলাদেশের ৩২ হাজার ৬৬৬টি স্থানে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

এরই মধ্যে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বরিশাল, পাবনা ও কিশোরগঞ্জে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে ঘটনার পর প্রত্যাহার করা হয়েছে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। ৮ অক্টোবর, ২০২৪।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) বলেছেন, "হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।"

সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছেন না সনাতন সম্প্রদায়ের অনেকে।

ঢাকার একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে কাজ করেন মনি মিত্র। তিনি বলেন, "প্রতি বছর পূজার শুরু আগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা খবর পাই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত ১৫ দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুরের খবর এসেছে। এসব ঘটনায় স্বাভাবিকভাবে আমাদের ভীতির মধ্যে ফেলে দেয়।"

মনি মিত্র বলেন, “আমরা নির্ভয়ে-নির্বিঘ্নে পূজা পালন করতে চাই। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে আমাদের এটাই চাওয়া।”

গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে উপজেলার সাহাপাড়ার শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ মন্দিরে দুর্বৃত্তরা নির্মাণাধীন চারটি প্রতিমা ভাঙচুর করে।

সে প্রসঙ্গে, মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক দীপ্ত সাহা গণমাধ্যমকে বলেন, "১৯ বছর ধরে এই মন্দিরে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। এবারই প্রথম মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করা হলো। এতে পূজা নিয়ে শঙ্কিত আমরা।"

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

বাংলাদেশে মূর্তি ভাঙচুর ও হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত বলেছে, "এ ধরনের ঘটনা ঠিক নয় এবং এগুলো ভালো নয়।"

শুক্রবার (৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, "আমি আরও বলতে চাই যে আমরা যখন সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলি, তখন এর মধ্যে দুর্গাপূজা এবং দশমী সম্পর্কেও আমাদের উদ্বেগ অন্তর্ভুক্ত থাকে।’

মুখপাত্র বলেন, "আমরা আশা করি যে সেখানে (বাংলাদেশে) সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের নিরাপত্তা দেবে এবং তাদের চাহিদা পূরণ করবে।"

বাংলাদেশের পূজামণ্ডপে হামলা বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে সোমবার (৭ অক্টোবর) বলেন, “কোনো পূজা মণ্ডপে হামলা হলে সেটা বাংলাদেশের সরকার দেখবে। এটা নিয়ে অন্য কোনো দেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।”

ফাইলঃ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল।

এবছরের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর হামলার প্রেক্ষিতে ভারত সরকার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ১৮ সেপ্টেম্বর জানিয়েছে, ৪ অগাস্ট থেকে ২০ অগাস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

তাদের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মধ্যে ৯ জনকে হত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ/গণধর্ষণ, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ; ৯১৫টি বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; ৯৫৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; বসতবাড়ি দখল একটি; ৩৮টি শারীরিক নির্যাতন এবং ২১টি জমি/ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখলের ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া ২০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ার সেনেটর বেন কার্ডিন এবং সদস্য সেনেটর ক্রিস মারফি, সেনেটর ভ্যান হলেন ও সেনেটর জেফ মার্কলি যৌথভাবে এক চিঠিতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া ও কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

২৬ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যকার বৈঠকে দুই নেতা দু'দেশের অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ ছাড়াও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ বাংলাদেশের সকলের জন্য মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।

(এই প্রতিবেদন তৈরিতে বিশেষ সহযোগিতা করেছেন আদিত্য রিমন।)