শ্রী লঙ্কাঃ মার্ক্সবাদী আনুরা কুমারা দিসানায়াকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত, দেশের 'নতুন ইতিহাস' রচনার অঙ্গীকার

শ্রী লঙ্কার নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আনুরা কুমারা দিসানায়াকা। ফটোঃ ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

শ্রী লঙ্কার সদ্য নির্বাচিত মার্ক্সবাদী প্রেসিডেন্ট এই দেউলিয়া-প্রায় দ্বীপরাষ্ট্রের ইতিহাস “নতুন করে লিখতে” তাকে সাহায্য করার জন্য রবিবার দেশবাসীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নজিরবিহীন আর্থিক সংকট ঘিরে তৈরি হওয়া অসন্তোষে জর্জরিত ভোটে জয়লাভ করেই তার এই আহ্বান।

সপ্তাহান্তে অনুষ্ঠিত ভোটে পিপল’স লিবারেশন ফ্রন্টের ৫৫ বছর বয়সী নেতা আনুরা কুমারা দিসানায়াকেকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ বেশি ভোট পেয়েছেন।

এক সময়ের প্রান্তিক নেতা, যার দল চার বছর আগে সংসদীয় নির্বাচনে চার শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছিল, বিপুল সমর্থন লাভ করেছেন যখন অর্থনৈতিক মন্দা শ্রী লঙ্কার উপর ব্যাপক কষ্ট ও অসচ্ছলতা চাপিয়ে দেয়।

বিজয় ঘোষণার পরেই এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “কয়েক শতক ধরে আমরা যে স্বপ্ন লালন করছি তা অবশেষে সত্যি হতে চলেছে।”

“এই বিজয় সকলের," তিনি আরও বলেন। "আশা ও প্রত্যাশায় ভরা লক্ষ লক্ষ চোখ আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছে এবং আমরা সম্মিলিতভাবে শ্রী লঙ্কার ইতিহাস নতুনভাবে লিখতে প্রস্তুত।”

শ্রী লঙ্কার জাফনা শহরে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার দলের সমর্থকরা দিসানায়াকের বিজয়ে উল্লাস করছেন। ফটোঃ ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রানিল ভিক্রেমেসিঙ্ঘে মাত্র ১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। তিনি ২০২২ সালের অর্থনৈতিক ভাঙনের চূড়ান্ত সময় দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং আইএমএফ বেল-আউট শর্তাবলী অনুযায়ী কঠোর নীতি আরোপ করেছিলেন।

তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, “ইতিহাস আমার প্রচেষ্টাকে বিচার করবে, তবে আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি যে, এই দেশকে তার অন্যতম অন্ধকার সময়কালে স্থিতিশীল করতে আমি আমার সর্বোচ্চটা করেছি।”

তিনি বিজয়ী দিসানায়াকেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং বলেছেন, তিনি “আত্মবিশ্বাসী” যে, এই রাজনীতিক “শ্রী লঙ্কাকে অব্যাহত প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার পথে নিয়ে যাবেন।”

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, দিসানায়াকেকে সোমবার সকালে কলম্বোর ঔপনিবেশিক আমলের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েটে শপথ পাঠ করানো হবে।

ব্যর্থ বিপ্লব থেকে সফল নির্বাচন

দিসানায়াকের একদা-প্রান্তিক মার্ক্সবাদী দল ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে দুটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিল যার ফলে ৮০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়।

তবে, শ্রী লঙ্কার সংকট দিসানায়াকের জন্য একটা সুযোগ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি এই দ্বীপরাষ্ট্রের “দুর্নীতিগ্রস্ত” রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন এবং একে ভিত্তি করেই তিনি বিপুল জনসমর্থন লাভ করেছেন।

শনিবারের নির্বাচনে শ্রী লঙ্কার ১ কোটি ৭১ লক্ষ যোগ্য ভোটারের মধ্যে প্রায় ৭৬ শতাংশ ভোট দিয়েছেন।

আট সপ্তাহব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থনৈতিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। দেশের মারাত্মক অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় ভিক্রেমাসিঙ্ঘে যেসব কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ ছিল।

তবে দিসানায়াকের দলের এক নেতা এএফপিকে বলেন, তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সাথে চুক্তি “ছিঁড়ে ফেলে দেবে না” কিন্তু সেটা পরিবর্তন করার চেষ্টা করবে।

“এই চুক্তি মানা বাধ্যতামূলক, কিন্তু পুনরায় আলোচনার সুযোগ রয়েছে,” বলেন বিমল রাতনায়াকে।

তিনি বলেন দিসানায়াকে আয়কর কমানোর অঙ্গীকার করেছেন, যেটা ভিক্রেমাসিঙ্ঘে দ্বিগুণ করেছিলেন। তিনি খাদ্য এবং ওষুধের উপর আরোপ করা বিক্রয় করও কমিয়ে দেবেন।

শ্রী লঙ্কায় নির্বাচনের পর ভোট গণনার সময় সারা দেশে কারফিউ দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। ফটোঃ ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব

ভিক্রেমাসিঙ্ঘে অর্থনীতি স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে তাঁর ব্যয় সংকোচ করার কঠোর অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করার জন্য পুনরায় নির্বাচিত হতে চেয়েছেন। তাঁর নীতিমালা শ্রী লঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ের খাদ্য, জ্বালানী এবং ওষুধের অভাব দূর করতে সক্ষম হয়।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে যে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় তার মুখে প্রেসিডেন্ট গটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। ভিক্রেমাসিঙ্ঘে তাঁর দু’বছরের শাসনামলে পরিস্থিতি শান্ত করতে সক্ষম হন।

কিন্তু আইএমএফের সাথে ২৯০ কোটি ডলারের সাহায্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভিক্রেমাসিঙ্ঘে আয়কর বৃদ্ধিসহ অন্যান্য যেসব কঠোর পদক্ষেপ নেন, তার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে।

সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ থেকে ২০২২ সালে, শ্রী লঙ্কায় দারিদ্রর হার দ্বিগুণ বেড়ে ২৫ শতাংশে চলে যায় এবং ২৫ লক্ষ মানুষ নতুন করে দারিদ্র সীমার নিচে চলে যান।

ভারতকে আশ্বাস

দিসানায়াকের দল ভারতকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছে যে, তিনি যে প্রশাসনের নেতৃত্ব দেবেন, তারা তাদের উত্তরের প্রতিবেশী আর চীনের মধ্যে ভু-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পর্বে না।

নয়া দিল্লি, তাদের দৃষ্টিতে শ্রী লঙ্কায় বেইজিং-এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারতীয় মহাসাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক যাত্রাপথে শ্রী লঙ্কার অবস্থান।

“শ্রী লঙ্কার ভূমি কোন দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না,” রাতনায়াকে এএফপিকে বলেন।

“আমরা আমাদের অঞ্চলের ভু-রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ, কিন্তু আমরা তাতে অংশগ্রহণ করবো না,” তিনি বলেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করা এক বার্তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার জন্য দিসানায়াকেকে অভিন্দন জানান।

"ভারতের 'প্রতিবেশী প্রথম' নীতিতে শ্রী লঙ্কার বিশেষ স্থান রয়েছে," মোদী বলেন। "আমাদের জনগণ এবং গোটা অঞ্চলের অগ্রগতির লক্ষ্যে আমাদের বহুমুখী সহযোগিতা আরও জোরদার করার জন্য আপনার সাথে কাজ করার অপেক্ষায় আছি।"