রাশিয়া জানিয়েছে, তারা মঙ্গলবার মহাসমুদ্রের বিশাল অংশ জুড়ে “ওশেন-২০২৪” নামে একটি নৌ এবং বিমান সামরিক মহড়া শুরু করেছে, যেখানে ৪০০ নৌজাহাজ, অন্তত ১২০ যুদ্ধ বিমান এবং ৯০ হাজারের বেশি সৈন্য অংশ নেবে।
এই বিশাল মহড়া, যেটায় চীন অংশ নিচ্ছে, সেপ্টেম্বর ১৬ পর্যন্ত চলবে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই মহড়া পর্যবেক্ষণ করতে অন্তত ১৫টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, মস্কো “বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর” সাথে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করার দিকে “বিশেষ মনোযোগ” দেয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দেন যে, তারা যেন এশিয়াতে মস্কোকে টেক্কা দেয়ার চেষ্টা না করে।
“কথিত রুশ হুমকি মোকাবেলা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে আটকানোর অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্ররা রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে, আর্কটিক অঞ্চলে এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে,” টেলিভিশনে রাশিয়ার সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে পুতিন মঙ্গলবার বলেন। তিনি বলেন, ওয়াশিংটন এবং তার মিত্ররা, “তথাকথিত সম্মুখ জোনে মাঝারি এবং স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করার পরিকল্পনা খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করছে।”
এক সাড়ি মহড়া
রাশিয়া ও চীন চলতি মাসে বেশ কয়েকটি যৌথ সামরিক মহড়া চালাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করতে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের মধ্যে নিরাপত্তা সমন্বয় মোকাবেলায় এই যৌথ নৌ ও বিমান মহড়া চলছে।
“রাশিয়া দেখাতে চায় যে তারা ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ চালানোর মধ্যেও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক শক্তি মোতায়েন করতে পারে, এবং চীন দেখাতে চায় যে তারা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে পারে এবং দক্ষিণ চীন সাগর ও জাপানের আশেপাশেও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে," বলেন জাপানের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটির আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ স্টেফেন নাগি।
চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সোমবার জানিয়েছে, জাপান সাগর ও ওখোটস্ক সাগরের কাছে জলসীমা ও আকাশসীমায় নিরাপত্তা হুমকির জবাব দেওয়ার সক্ষমতা জোরদার করতে এবং দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত সহযোগিতা আরও গভীর করার লক্ষ্যে উভয় দেশ যৌথ নৌ ও বিমান মহড়া চালাবে।
চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে জাপানের কাছাকাছি যৌথ মহড়া করা ছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরে চীন ও রাশিয়ার নৌবহর তাদের পঞ্চম যৌথ টহল পরিচালনা করবে এবং রাশিয়া পরিচালিত “ওশেন ২০২৪” নামের কৌশলগত মহড়ায় অংশ নেবে।
“রাশিয়া চীনের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ার মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফ্রন্টে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বাড়ানোর আশা করছে যা ওয়াশিংটনকে ইউরোপে সেনা মোতায়েন কমাতে বাধ্য করতে পারে," বলছেন তাইওয়ানের তামকাং বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক বিশেষজ্ঞ লিন ইং-ইউ।
জাপানের জন্য উদ্বেগ
তিনি আরও বলেন, অপর দিকে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে চীন তাইওয়ান প্রণালীর কাছাকাছি জলসীমা থেকে জাপানের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চায়।
ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে লিন বলেন, “জাপানকে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা হুমকিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে যাতে তারা তাইওয়ান প্রণালীতে মনোনিবেশ করার মতো শক্তি না পায়।"
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও রাশিয়া জাপানের কাছে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে, যে তৎপরতাকে টোকিও "গভীর উদ্বেগের বিষয়" বলে অভিহিত করেছে।
জুলাই মাসে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিরক্ষা শ্বেতপত্রে জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় লিখেছে, "এই যৌথ তৎপরতার পুনরাবৃত্তি স্পষ্টতই জাপানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে এবং জাপানের জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি গুরুতর উদ্বেগ।”
নাগি বলেন, আপাতত সামরিক সহযোগিতা কীভাবে বিকশলাভ করতে পারে সে বিষয়ে জাপান বেশি উদ্বিগ্ন। যখন তারা মহড়া পরিচালনা করবে তখন তারা একসঙ্গে কী করতে পারে সেই সীমাবদ্ধতা এখনও রয়েছে, তিনি বলেন।
“জাপান উদ্বিগ্ন যে চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার সহযোগিতা সমুদ্রপথের বাণিজ্য-নৌসহ নানা যোগাযোগকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য ব্যবহার করা হবে কি না, বা উত্তর কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য বা তাইওয়ানের সাথে একরকম জোরপূর্বক পুনরেকত্রীকরন দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য," ভয়েস অফ আমেরিকাকে এক ফোন সাক্ষাৎ কারে তিনি বলেন। “রাশিয়ান এবং চাইনিজরা একে অপরের পাশাপাশি চলবে, একে অপরের পাশাপাশি উড়বে অথবা তাদের নৌকাগুলি কিভাবে চলবে সেটাও সমন্বয় করবে কিন্তু তারা একে ওপরের সিস্টেম ব্যবহার এবং ইন্টারকমান্ড বিকাশ করেনি।"
কৌশলগত, যোগাযোগ সহযোগিতা বাড়ানো
তাদের সহযোগিতার সীমাবদ্ধতা থাকলেও অন্যান্য বিশ্লেষকরা বলছেন যে, রাশিয়া ও চীন এখনও তাদের কৌশলগত সহযোগিতা বাড়ানর ক্ষেত্রে, যেমন যন্ত্রাংশ, জ্বালানী বা নানা ধরণের পরিষেবা বিনিময় বা ডেটা বা যোগাযোগের চ্যানেল ভাগ করে নেওয়া ক্ষেত্রে যৌথ সামরিক মহড়া ব্যবহার করে থাকে।
“চীন ও রাশিয়ার সেনাবাহিনী একে অপরকে ভালভাবে বোঝার জন্য এবং মাঠে একে অপরকে আরও ভালভাবে সমর্থন করার সক্ষমতা গড়ে তোলা উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ," সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অফ পাবলিক পলিসির ভিজিটিং সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড্রু থম্পসন টেলিফোনে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন।
তাইপে-তে লিন বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ার মাধ্যমে চীন তার সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়াতে পারে যেহেতু ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রুশ বাহিনী বাস্তব যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
“যেহেতু রাশিয়ার নৌবাহিনী ইউক্রেনের ড্রোন বা জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা মোকাবেলা করেছে, সে কারণে চীনা নৌবাহিনী রাশিয়ার কাছ থেকে তাইওয়ান প্রণালীতে সম্ভাব্য অনুরূপ যুদ্ধ কীভাবে মোকাবেলা করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নিতে পারে," তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন।
নেটোর বিরুদ্ধে অবস্থান
জাপানের আশে পাশে চীন ও রাশিয়ার সামরিক মহড়া যুক্তরাষ্ট্র ও নেটো মিত্রদের ঠেকানোর জন্য তাদের ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টার অংশ বিশেষ। জুলাই মাস থেকে বেইজিং ও মস্কো দক্ষিণ চীন সাগর, আলাস্কা উপকূল এবং ফিনল্যান্ড উপসাগরসহ বিশ্বের বিভিন্ন অংশে কমপক্ষে তিনটি যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়েছে।
“বেইজিং ও মস্কো ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যে জোর প্রতিরক্ষা সহযোগিতা মোকাবেলায় করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিশ্বজুড়ে সামরিক মহড়ার সংখ্যা বাড়াচ্ছে," রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের সহযোগী ফেলো সারি আরহো হাভরেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বলেন।
ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও নেটোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর চেষ্টা সত্ত্বেও, নাগি বলেন, চীন ও রাশিয়া তাদের অংশীদারিত্বকে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে যাবে না।
“যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যা করছে, রাশিয়া ও চীন তার প্রত্যুত্তর দেওয়া অব্যাহত রাখবে কিন্তু উত্তেজনা বাড়াবে না। কারণ, বেইজিং গ্লোবাল সাউথের কাছে তার বক্তব্য বজায় রাখতে চায় যে তারা আধিপত্যবাদী শক্তি নয়," তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন।
চীনা কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল স্যাম পাপারো পিপলস লিবারেশন আর্মির সাদার্ন থিয়েটার কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল উ ইয়ানানের সঙ্গে ভিডিও টেলিফোনে কথা বলেছেন। ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল এবং দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান প্রণালীসহ উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার মতো স্থানগুলোতে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়।