যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনঃ গাজা যুদ্ধ যেভাবে মুসলিম ভোটারদের চিন্তা-ভাবনায় প্রভাব ফেলছে

নিউ ইয়র্কের ইউনিয়ন স্কয়ারে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ। ফটোঃ ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে সেনজেল শেফার ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে তাঁর রাজনৈতিক বাসা হিসেবে গণ্য করেছেন। তিনি প্রতিটি নির্বাচনে - প্রেসিডেন্সিয়াল, কংগ্রেস, প্রাইমারিতে তাঁর দলের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন।

কিন্তু এবারের নির্বাচনের দিন, তিনি ভিন্ন পথে হাঁটবেন। শেফারের মত মুসলিম আমেরিকান ভোটারদের জন্য, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের অবসান এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

আফগান বংশোদ্ভূত আমেরিকান শেফার ভার্জিনিয়া রাজ্যে প্রযুক্তি শিল্পে কাজ করেন। গাজা যুদ্ধ নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের নীতি নিয়ে তিনি ক্ষুব্ধ, যে কারণে তিনি তৃতীয় দলের প্রার্থীকে ভোট দেবেন।

“একজন আমেরিকান ভোটার হিসেবে, এটা সম্ভবত আমার জন্য এই মুহূর্তে সব চেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত,” তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন।

শেফার একা নন। দশ মাস ধরে চলমান গাজা যুদ্ধ ঐতিহ্যগত ভাবে ডেমোক্র্যাট ভোট ব্যাঙ্ক যেমন ঐক্যবদ্ধ করেছে, তেমনি সেটায় চির ধরিয়েছে। এই ভোট ব্লক ৩৫ লক্ষ মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করে।

বেশির ভাগ মুসলিম ভোটার যদিও গাজা যুদ্ধকে তাদের প্রধান ইস্যু মনে করে, তারা প্রার্থীদের নিয়ে বিভক্ত। অনেক ভোটার দুই প্রধান দলের প্রার্থীদের ইসরায়েলপন্থী নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ, এবং তারা তৃতীয় দলের বিষয় দেখছেন।

কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশন্স বা সিএআইআর ২৫-২৯ অগাস্ট-এ যে জনমত জরীপ চালায়, তাতে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস এবং গ্রিন পার্টির ঘোরতর ইসরায়েল-বিরোধী প্রার্থী জিল স্টেইন, দুজনের প্রত্যেকে প্রায় ২৯ শতাংশ সমর্থন পান।

রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প ১১ শতাংশ এবং তারপর আরও দুজন প্রার্থী দশের নিচে সমর্থন পান। ষোল শতাংশর বেশি এখনো সিদ্ধান্ত নেননি।

জরীপের ফলাফলে প্রেসিডেন্সিয়াল প্রচারণার আগের দিকের ধারনার প্রতিফলন ঘটেছে, এবং তা প্রমাণ করেছে গাজা যুদ্ধ ডেমোক্র্যাটদের প্রতি মুসলিম সমর্থন কতটুকু ক্ষয় করেছে।

মিশিগান রাজ্যের হ্যামট্র্যাকে আরব আমেরিকান ভোটাররা ডেমোক্র্যাট দলের প্রাইমারিতে 'আনকমিটেড' এর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। ফাইল ফটোঃ ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪।

বাইডেন ২০২০ সালের নির্বাচনে ৬৫ শতাংশ মুসলিম ভোট পান। এ’বছর সেই সমর্থন ধসে পড়ে, এবং ডেমোক্র্যাট দলের প্রাইমারিতে দলের সাত লক্ষ ভোটার বাইডেনকে সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের অনেকেই মুসলিম, যারা গুরুত্বপূর্ণ ‘সুইং’ রাজ্যে বাস করেন, যেসব রাজ্যের ফলাফল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী নির্ধারণ করতে পারে।

‘আনকমিটেড’ নামে পরিচিত এসব ভোটার এখনো কারও পক্ষে সমর্থন দিচ্ছে না এবং তারা তৃতীয় দলের প্রার্থীদের দিকে ঝুঁকছেন বা এখনো সিদ্ধান্ত নেননি।

দ্য ইন্সটিটিউট ফর সোশাল পলিসি (আইএসপিইউ), যে মুসলিম গবেষণা গোষ্ঠী জুলাই মাসে জরীপ পরিচালনা করে, তারা এই ভোটারদের ‘সুইং মুসলিম ভোটার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অর্থাৎ, গাজা যুদ্ধ নিয়ে তাদের যে উদ্বেগ, সেটার স্বীকৃতি দিয়ে সঠিক নীতি অবলম্বন করলে তাদের ভোট জেতা সম্ভব।

“যে প্রার্থী দেখাতে পারবে যে তিনি গাজা যুদ্ধ নিয়ে পথ পরিবর্তন করবেন, এবং যুদ্ধ বিরতি অর্জন করলে মুসলিম ভোটারদের উপর এবং তারা কাকে ভোট দেবে, তার উপর প্রভাব পরবে,” বলছেন আইএসপিইউ-এর গবেষণা বিভাগের পরিচালক সাহের সেলদ।

নির্বাচন হতে আর দু’মাস বাকি থাকতে, এই ‘সুইং মুসলিম ভোটাররা’ শেষমেশ কাকে ভোট দেবেন, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

হ্যারিসকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি বাইডেনের চেয়ে বেশি সহানুভূতিশীল হিসেবে দেখা হয়। মুসলিম ভোটারদের মধ্যে তাঁর সমর্থন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়ে এগিয়ে আছে।

কিন্তু অ্যাক্টিভিস্টরা আরও বেশি চায়। তারা যুদ্ধ বিরতি এবং ইসরায়েলের উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দাবী করছে।

“আমি জানি না, সহানুভূতি ভোট নিয়ে আসতে পারবে কি না। আমার মনে হয়, নীতিমালা ভোট জয় করে,” বলছেন উইসকন্সিন রাজ্যের একজন ‘আনকমিটেড’ ভোটার রোমান ফ্রিটজ।

ফ্রিটজ বলছেন, যুদ্ধবিরতি আর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ছাড়া, হ্যারিস, “নভেম্বরে জেতার জন্য যত ভোট প্রয়োজন, তা তিনি পাবেন না।”

দুই প্রধান দলের প্রার্থী, ডেমোক্র্যাটদের কমালা হ্যারিস (বাঁয়ে) এবং রিপাবলিকানদের ডনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েলকে সমর্থনের কারণে দুজনের কাওকেই আমেরিকান মুসলিম ভোটারদের বিরাট অংশ সমর্থন করতে পারছেন না।

হ্যারিস অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেন, কিন্তু তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তি সমর্থন করেন।

“গাজায় স্থায়ী যুদ্ধ বিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তির জন্য যে খসরা চুক্তি তৈরি আছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিস সেটা সমর্থন করেন,” হ্যারিস-ওয়ালজ প্রচারণা টিমের একজন মুখপাত্র ভিওএ-এর একটি প্রশ্নের জবাবে বলেন।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হ্যারিসের প্রচারণা টিম জনসংযোগ বৃদ্ধি করেছে। প্রচারণা দলের ম্যানেজার জুলি শাভেজ রড্রিগেজ মিশিগানে আরব এবং ইহুদী নেতাদের সাথে বৈঠক করেন।

মুখপাত্র বলেন, হ্যারিস “ফিলিস্তিনি, মুসলিম, ইসরায়েলি এবং ইহুদী কমিউনিটির নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ অব্যাহত রাখবেন, যেটা তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পুরো সময় করেছেন।”

মুসলিম কমিউনিটির সাথে ট্রাম্পের যোগাযোগ মনে হয় কিছুটা সীমিত। বছরের শুরুর দিকে, বিগত ট্রাম্প প্রশাসনের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা এবং ট্রাম্পের এক মেয়ের স্বামী মিশিগানে আরব নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

মন্তব্যের জন্য ট্রাম্প-ভ্যান্স প্রচারণা টিমের মুখপাত্রের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোন জবাব দেয় নি।

হ্যারিস সমর্থক

উত্তর ভার্জিনিয়ার বাসিন্দা আইটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার আরিফ খানের কাছে, প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে পছন্দ বাছাই করাটা হবে “কে কার থেকে কম খারাপ” এই ভিত্তিতে।

গাজা যুদ্ধের কারণে তিনি রাজনৈতিক বিষয়ে আরও গভীরভাবে আগ্রহী হয়েছেন, যে কারণে তিনি তাঁর দুটি টিন এজ সন্তান নিয়ে ফিলিস্তিনপন্থী সমাবেশে যোগ দিয়েছেন।

“আগে কখনো এত রকম প্রতিবাদ বিক্ষোভে জড়িত ছিলাম বলে মনে পড়ে না,” তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন।

তিনি বলেন, তিনি এমন একজন প্রার্থী খুঁজছেন যিনি, তাঁর ভাষায়, “গণহত্যা” বন্ধ করার জন্য ইসরায়েলের উপর চাপ প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক হবেন। ইসরায়েল গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে।

খান বলেন, সেরকম কেউ না থাকলে তিনি নভেম্বরে হ্যারিসকে ভোট দেবেন। তিনি ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের ক্ষেত্রে হ্যারিসকে বাইডেনের চেয়ে “কম উগ্র” এবং সমাধানের জন্য ট্রাম্পের চেয়ে বেশি আগ্রহী বলে মনে করেন। “আমার বিশ্বাস, কমালা হ্যারিস ভারসাম্য বজায় রেখে অগ্রসর হওয়া সমর্থন করবেন,” খান বলেন।

ট্রাম্প সমর্থক

অন্যান্যরা ইসরায়েল ইস্যুতে ট্রাম্প এবং হ্যারিসের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য দেখতে পান না। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক রেস্তরাঁ মালিক সামি খান গাজা যুদ্ধকে মুসলিম ভোটারদের জন্য “সব চেয়ে বড় ইস্যু” মনে করেন।

তবে নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে খুব কম পরিবর্তন আসবে বলে তিনি মনে করেন।

“আমাদের এখানে আসলেই খুব একটা চয়েস নাই,” খান বলেন (যার সাথে আরিফ খানের কোন আত্মীয়তা নেই)। “নির্বাচনে যেই জিতুক না কেন, এই সরকার এখন যা করছে সেটা করাই হয়তো সরকারের নীতি।”

ইসরায়েল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি খুব সম্ভবত অপরিবর্তিত থাকবে এবং সে কারণে খান বলেন তিনি ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। তিনি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তাঁর অর্থনৈতিক পরিচালনার প্রশংসা করেন।

“অর্থনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ,” তিনি বলেন। “ব্যাপারটা হচ্ছে, যদি ট্রাম্প যেতে, তাহলে সেটা অবশ্যই অর্থনীতির জন্য ভাল হবে।”

খান এই অঞ্চল এক ডজনের বেশি রেস্তরাঁর মালিক, এবং তিনি রিপাবলিকান-ঘেঁষা মুসলিম ভোটারদের এক-তৃতীয়াংশর প্রতিনিধিত্ব করেন। সবাই যদিও ট্রাম্পকে সমর্থন করেন না, তবে জনমত জরীপের ফলাফল অনুযায়ী, তাদের মাঝে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের আবেদন বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে।

মুসলিম আমেরিকানরা বিভিন্ন মতের মানুষ। গাজা যদিও তাদের অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে, তাদের উদ্বেগগুলোতে সাধারণ ভোটারদের মতামতের প্রতিফলন দেখা যায়ঃ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, অভিবাসন এবং পরিবেশ।

ট্রাম্প “হচ্ছেন একজন ব্যবসায়ী, এবং তিনি জানেন অর্থনীতি কীভাবে ঠিক করতে হবে,” খান বলেন। “ তিনি আপনাকে অনেক উৎসাহ দেবেন।”

ডেমোক্র্যাট থেকে রিপাবলিকান

অন্যান্য রিপাবলিকান-ঘেঁষা মুসলিম প্রেসিডেন্টের দাবীর সাথে একমত, যে তাঁর সময় সারা বিশ্ব আরও বেশি শান্ত এবং সমৃদ্ধ জায়গা ছিল। ট্রাম্পের এই দাবী নিয়ে ফ্যাক্ট চেকাররা প্রশ্ন তুলেছেন।

“সব কিছু ঠিক-ঠাকই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করে সব কিছু ভেঙ্গে পড়ছে,” বললেন ভার্জিনিয়ার গ্রেট ফলস-এর বাসিন্দা ড. রশিদ কোটানি।

কোটানি আগে রিপাবলিকানদের পক্ষে ভোট দিতেন। তিনি সাম্প্রতিক সময় ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। কিন্তু আবার পক্ষ বদলাতে যাচ্ছেন।

এই পরিচিত পাকিস্তানি আমেরিকান ডাক্তার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেমোক্র্যাটদের বাম-ঘেঁষা নীতির কারণে ইতোমধ্যেই তাদের প্রতি বিরক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, বাইডনের গাজা সংঘাত নীতি ছিল তাঁর সহ্যের বাইরে।

“আমার প্রত্যাশা ছিল তিনি এই বিপর্যয় থামিয়ে দেবেন,” কোটানি বলেন। “আমার প্রত্যাশা ছিল ফিলিস্তিনে যা হচ্ছে সে ব্যাপারে তিনি ন্যায়বান হবেন। তিনি শুধু বলতে থাকেন, ‘হ্যাঁ, আমরা এবিষয়ে কিছু করবো,’ কিন্তু কিছুই করা হয় নাই।”

কোটানি এখন ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। কিন্তু অন্য অনেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। দুই প্রার্থীর প্রচারণা টিমের কোন একটা এদের মন জয় করতে পারবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গাজায় যুদ্ধবিরতি তাদের কাওকে হ্যারিসের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে। আইএসপিইউ জরীপে দেখা যায়, ‘সুইং মুসলিম ভোটারদের’ মধ্যে ৯১ শতাংশ যুদ্ধবিরতিপন্থী প্রার্থীকে সমর্থন করবে।

কিন্তু যুদ্ধ বিরতি হলেও, অনেকে তৃতীয় দলের প্রার্থী বেছে নিতে পারেন, বা নির্বাচনে ভোট নাও দিতে পারেন। এর ফলে মুসলিম ভোট ভাগ হয়ে যাবে।

অনেকের আশঙ্কা, এর ফলে ৩৫ লক্ষ মুসলিমের কমিউনিটির রাজনৈতিক শক্তি কমিয়ে দেবে। তাদের ভোটা ভাগ হয়ে গেলে, নির্বাচন প্রভাবিত করার ক্ষমতাও কমে যাবে। \

তবে কোটানি এখানে আশার আলো দেখছেন।

“ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপনি অনেক কিছু অর্জন করতে পারেন, কিন্তু এটা গণতান্ত্রিক বিবর্তনের অংশ,” কোটানি বলেন। “আমার যখন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তখন আমরা বুঝতে পারছি কী ঘটছে। আমরা ভিন্ন পথে যেতে পারি, কিন্তু আমি সেটাকে খারাপ কিছু মনে করি না।”

ভয়েস অফ আমেরিকার দিওয়া, তুর্কি এবং উর্দু বিভাগ এই প্রতিবেদনে অবদান রেখেছে