বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২, ক্ষতিগ্রস্ত ৫৮ লাখ মানুষ

সম্প্রতি বন্যায় বিভিন্ন জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ জনে দাঁড়িয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি বন্যায় ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও মৌলভীবাজার জেলায় আরও ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এবারের বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ জনে দাঁড়িয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৯ অগাস্ট) চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত মোট ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় ১৪ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, ফেনীতে ১৭ জন, নোয়াখালীতে ৮ জন, কক্সবাজারে ৩ জন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে মারা গেছেন। এর মধ্যে ৩৯ জন পুরুষ, ৬ জন নারী ও ৭ শিশু। মৌলভীবাজার জেলায় এখনো একজন নিখোঁজ রয়েছেন।

এছাড়া ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার জেলার ৬৮টি উপজেলায় ১০ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৯টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

১১টি জেলার ৪৯২টি পৌরসভা বা ইউনিয়নে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৮ লাখ ৮০ হাজার ৪৬৩ জন। ৩ হাজার ৪০৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৫ লাখ ২ হাজার ৫০১ জন মানুষ এবং ৩৬ হাজার ৪৪৮টি গৃহপালিত পশু রাখা হয়েছে।

বন্যাকবলিত এলাকায় মোট ৫৯৫টি মেডিকেল টিম চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে।

তিনি আরও জানান, বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে এ পর্যন্ত ৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ, ২০ হাজার ৬৫০ টন চাল, শুকনো খাবার বা অন্য খাবার এবং শিশু খাদ্য ও গো-খাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা।

বিপৎসীমার নিচে গোমতী নদীর পানি, কুমিল্লায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি

গোমতী নদীর পানি কমতে থাকায় কুমিল্লায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া, গত কয়েক দিনে কুমিল্লাতে বৃষ্টি না হওয়ায় এবং উজান থেকে পানি না আসায় পানির স্তর নামছে।

গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নদীর বুরবুড়িয়া বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি বের হয়ে যাওয়াও কমেছে। এর ফলে বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার পানি কমছে।

গোমতী নদীর পানি কমতে থাকায় কুমিল্লায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

এ ছাড়া, প্লাবিত কুমিল্লা জেলার দক্ষিণাঞ্চল লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার পরিস্থিতি উন্নতির দিকে।

জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, জেলায় ১০ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ পানিবন্দী আছে। ৭২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৭৮ হাজারেরও বেশি মানুষ।

বন্যাদুর্গতদের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ৩৩ লাখ নগদ টাকা ও ৬০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কুমিল্লায় পর্যাপ্ত ত্রাণ এসেছে। বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা ত্রাণগুলো বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।

এ ছাড়াও, বন্যার্তদের চিকিৎসার দায়িত্বে রয়েছে ২২৫টি মেডিকেল টিম।

টানা বৃষ্টিতে চুয়াডাঙ্গায় জলাবদ্ধতা

এদিকে টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে চুয়াডাঙ্গা শহরের বেশ কয়েকটি নিচু এলাকায় ও সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।

আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত ৪৮ ঘণ্টায় চুয়াডাঙ্গায় ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এর ফলে শহরের বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা নেই। তবে টানা বৃষ্টির ফলে মাথাভাঙ্গা নদীর পানির উচ্চতা বেড়েছে। নিচু এলাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতা বাড়তে পারে।

এই জলাবদ্ধতার কারণে চুয়াডাঙ্গার নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা এরই মধ্যে বেশ দুর্ভোগে আছেন। শহরের খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিপাকে পড়েছেন রিকশা ও ইজিবাইক চালকেরা। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় যাত্রী কমে যাওয়ায় তাদের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির আশায় অপেক্ষা করছেন স্থানীয়রা।

টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে বেশ কয়েকটি নিচু এলাকায় ও সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা শহরের শান্তিপাড়ার বাসিন্দা মন্টু মিয়া বলেন, “গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে বাড়ি থেকে পাড়ার মোড় হয়ে মূল শহরে যাওয়ার রাস্তাটি সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। বাচ্চাদের স্কুলে নেওয়ার জন্য ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে দূরত্ব বাড়ছে। প্রতি বছর বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।”

একই এলাকার স্কুল শিক্ষক উজ্জল বলেন, “প্রতিদিনের কাজকর্ম করতে পারছি না। বৃষ্টির পানি ঘরের সামনে জমে আছে, বের হওয়া মুশকিল হয়ে গেছে। মেয়েরা বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। কেউ পড়তে আসতে পারছে না। প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”

চুয়াডাঙ্গা শহরের রিকশাচালক হান্নান মিয়া বলেন, “বৃষ্টির কারণে রাস্তায় মানুষ কমে গেছে। ১০-১১ দিন ধরে বৃষ্টির কারণে তেমন যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। যা আয় করছি, তাতে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”

ইজিবাইক চালক সাগর হোসেন বলেন, “ভাড়া এমনিতেই কম, তার ওপর যাত্রীও কম। সারা দিন ইজিবাইক চালিয়ে যা পাই, তাতে তেল কেনার টাকাই ওঠে না। এভাবে চলতে থাকলে পরিবার কীভাবে চালাব, বুঝতে পারছি না।”

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান জানান, গত ৪৮ ঘণ্টায় চুয়াডাঙ্গায় মোট ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বুধবার থেকে আবহাওয়া স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এসময় আকাশে মেঘ থাকলেও সূর্যের দেখা পাওয়া যাবে।

চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ আহম্মেদ বলেন, “টানা বৃষ্টির কারণে মাথাভাঙ্গা নদীর পানির উচ্চতা বেড়েছে, তবে এ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কোনো আশঙ্কা নেই। আমরা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি। শহরের কিছু নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতার সমস্যা তৈরি হয়েছে, যা আমাদের নজরে এসেছে। দ্রুততম সময়ে পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছি।”

তিনি আরও বলেন, মাথাভাঙ্গা নদীর হাটবোয়ালিয়া পয়েন্টে মঙ্গলবার পানির উচ্চতা ২ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এখন পর্যন্ত পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সাধারণত পদ্মা নদীর পানি বাড়লে মাথাভাঙ্গা নদীতে পানি বেড়ে যায়। তবে এখন পর্যন্ত পদ্মা নদীর পানি মাথাভাঙ্গা নদীতে আসেনি। পদ্মা নদীর পানি মাথাভাঙ্গায় আসলে পানির উচ্চতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।