বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দলের নেতারা এবং তাদের মিত্ররা স্বাগত জানিয়েছে। তবে একই সময়ে দেশের রাজনীতিতে জামাতের আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবর্তনে সংশয়ও প্রকাশ করা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন তারা ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে পুনঃ নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে সব সময় “অবৈধ” হিসেবে গণ্য করতেন, এবং জামাত নিষেধের নির্বাহী আদেশও তাদের কাছে “অবৈধ” ছিল।
“এটা বাতিলের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমরা দাবী জানিয়েছিলাম। প্রজ্ঞাপনটি সরকার আমাদের দাবি মোতাবেক বাতিল করে আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। একটা জুলুমকে প্রতিহত করে সরকার সুবিচার করেছে,” পরওয়ার এক লিখিত বক্তব্যে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন।
'বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়'
ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের এই সিদ্ধান্তের পরিণতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইমরান এইচ সরকার, যিনি ২০১৩ সালে ঢাকার শাহবাগে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সরকার বলেছেন, জামায়াতের রাজনীতিকে “পুনর্বাসন অপ্রত্যাশিত হলেও” অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সিদ্ধান্ত তাঁকে “অবাক করেনি।”
“এটি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়,” তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন। “সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পেছনে জামায়াতসহ মৌলবাদী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখন জাতির সামনে পরিষ্কার। পুরো প্রক্রিয়াটিই বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক, ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অংশ।”
গণজাগরণ মঞ্চ ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ জামায়েত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড দাবী করে।
“জামায়াত বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরির বিরোধিতাকারী সংগঠন, তারা কখনোই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বকে মেনে নিতে পারেনি,” ইমরান সরকার বলেন।
তবে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি, যারা দীর্ঘদিন ধরে জামায়েতে ইসলামির সাথে মিত্রতা বজায় রেখেছে, বুধবারের সরকারী প্রজ্ঞাপন স্বাগত জানায়। বিএনপি নেতারা বলেন যে, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়েতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করাই ঠিক হয়নি।
“তারা দীর্ঘকাল ধরে রাজনীতি করছে। সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। সুতরাং জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপনটি বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে,” বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগির ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেয়া এক সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় বলেন।
বিএনপি ২০০১ সালে জামায়েতের সাথে জোট বেঁধে নির্বাচনে লড়াই করে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে। জামায়েতের দুই শীর্ষ নেতা, মতিউর রহমান নিজামি এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মন্ত্রীসভায় পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
নির্বাচনমুখী জামায়াত
অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে ভবিষ্যতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেটাতে অংশ নেওয়ার আশা করছে জামায়েতে ইসলামি। তবে তার আগে তাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ নিষিদ্ধ করে ২০১৩ সালের উচ্চ আদালতের রায় বাতিল করতে হবে।
“জামায়াত একটি নির্বাচনমুখী দল। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে আমরা সে নির্বাচনে অংশ নিবো ইনশাআল্লাহ,” জামায়েত নেতা পরওয়ার বলেন।
সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সরকারের সিদ্ধান্তকে “যৌক্তিক” বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, আওয়ামী লীগ সাম্প্রতিক আন্দোলনকে “দমন ও প্রতিহত করার কৌশল” হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল।
“জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়টি বহু বছর ধরে আদালতে ঝুলে ছিল। তখন যদি তারা আইনগত ভাবে তাদেরকে নিষিদ্ধ করতো, তাহলে এটা নিয়ে প্রশ্ন আসতো না,” মজুমদার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন।
“আমরা নিজেরাও বহুবার বলেছি, এটা আওয়ামী লীগের করা উচিত। কিন্তু তারা করে নাই। এটা নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক খেলা খেলেছিল। এবার আন্দোলনের সময় তাদেরকে নিষিদ্ধ করাটা আওয়ামী লীগের খেলা ও কৌশলের অংশ ছিল,” তিনি বলেন।
বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ জামায়েতের পুনর্বাসন নেতিবাচক চোখে দেখছেন। তাদের একজন, আমেরিকান নাগরিক অ্যাডাম পিটম্যান, যিনি বাংলাদেশে এবং মিয়ানমার নিয়ে গবেষণা এবং লেখা-লেখি করেন।
পিটম্যান বলেন যে, জামাতের সুযোগ ছিল দেশের সংবিধান মেনে ২০০৮ সালের নির্বাচনী আইন মেনে নিজেদের সংস্কার করা। কিন্তু তারা সেটা করেনি।
“জামাতের কাছে এক দশক সময় ছিল নিজেদের আইন-সম্মত করে তোলা। জামাতের সামনে আদালতের একটি রায় ছিল যেটা ব্যবহার করতে পারতো: সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পরিত্যাগ করা; নেতৃতে নারীদের স্থান দেয়া; ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় অঙ্গিকার করা। তারা এসব না করার সিদ্ধান্ত নেয়,” ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় লিখেছেন পিটম্যান।
পিটম্যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের পরাজয় এবং উনবিংশ শতকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধে কনফেডারেট পক্ষের পতনের কথা উল্লেখ করেন।
“জামায়েত দেখিয়েছে জার্মানি কেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসিদের নিষিদ্ধ করে। কেন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র কনফেডারেটদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে দূরে রাখে। আপনি যদি জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট হতে চান, বা যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদী হতে চান, তাহলে যারা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে তাদের নামে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিতে পারবেন না,” পিটম্যান বলেন।