বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তাঁর প্রথম ভাষণে বলেন, দেশে নির্বাচন কবে হবে “সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত”, তাঁর সরকারের নয়। তিনি বলেন সরকার নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করবে।
“দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা,” ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে বলেন। “দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাবো যাতে হঠাৎ করে আমরা কখন যাব এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়। তারা যখন বলবে আমরা চলে যাবো।”
বাংলাদেশে জুলাই মাসে শুরু হওয়া গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ অগাস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার তিনদিন পর, শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মাদ শাহাবুদ্দিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করেন।
ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার মাত্র দুই সপ্তাহ শেষ হয়েছে বলে মন্তব্য করে বলেন যে, তিনি বুঝতে পারছেন তাদের কাছ থেকে জনগণের প্রচুর প্রত্যাশা রয়েছে।
“আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরণে সরকার বদ্ধপরিকর। শুধু বলবো আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে,” তিনি বলেন।
মামলা আর হামলা
ধৈর্য ধরার একটি উদাহরণ হিসেবে তিনি সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে তাদের দাবী পূরণ করার জন্য নিয়ম-বহির্ভূত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা থেকে বের হওয়া জরুরী বলে তিনি মন্তব্য করেন।
“ছাত্র জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসব কাজে ম্লান হয়ে যাবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাও ব্যাহত হতে পারে,” ড. ইউনূস বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দীর্ঘদিনের গনতন্ত্রহীন শাসন ব্যবস্থা “প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পর্বতসম চ্যালেঞ্জ” রেখে গিয়েছে। তিনি এসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন।
“নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করলাম, আমরা আমাদের মতানৈক্যের কারণে সেটা যেন হাতছাড়া না করে ফেলি এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এ সুযোগ এবার হারিয়ে ফেললে আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হয়ে যাব,” তিনি বলেন।
'কাজ করতে দিন'
তাঁর সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে সচিবালয়সহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দাবী আদায়ের লক্ষ্যে যেসব সমাবেশ হচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ড. ইউনূস বলেন যে “১৬ বছরের অনেক দুঃখ- কষ্ট জমা আছে,” যেটা তিনি বোঝেন। তবে তিনি ইঙ্গিত দেন যে বিক্ষোভ সরকারের কাজ ব্যাহত করতে পারে।
“আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সকল পথ বন্ধ হয়ে থাকবে,” তিনি বলেন। “আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া তা লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসংগতভাবে যা কিছু করার আছে আমরা অবশ্যই তা করবো,” তিনি বলেন।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের সময় বাংলাদেশের আনসার বাহিনীর সদস্যরা তাদের দাবীর পক্ষে সচিবালয়ের গেটমুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলেন। ভাষণ শেষ হওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শত শত ছাত্র সচিবালয়ে গিয়ে আনসারদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। একদিকে পুলিশ এবং ছাত্র আর অন্যদিকে আনসারদের মধ্যে সংঘর্ষে দুপক্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয় বলে জানা যায়। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
'গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক'
ড. ইউনূস তার ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের তরুণরা একটি “মহা সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে” এবং তিনি সবাইকে এই সুযোগ ব্যবহার করার কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
“আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিই। উদার, গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ,” তিনি বলেন।
ড. ইউনূস তার ভাষণে আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে “জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত এবং জবাবদিহীতামূলক কাঠামো” সৃষ্টির লক্ষ্যে পুলিশ কমিশন গঠনের কথা তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই-আগস্ট মাসে গণ-অভ্যুত্থানে বল প্রয়োগ ও হতাহতের ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধানকে বাংলাদেশে এসে তাদের তদন্ত শুরু করতে আমরা আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
“তদন্তের এই প্রক্রিয়া এ সপ্তাহেই শুরু হবে। তাদের প্রথম দল ইতোমধ্যে এসে গেছে,” তিনি বলেন।
জুলাই মাসের ১৫ থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ৪ অগাস্ট পর্যন্ত প্রায় ৪০০ লোক সহিংসতায় নিহত হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৫ থেকে ১১ অগাস্ট নতুন সহিংসতায় অন্তত ২৭২ জন নিহত হয়।