বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যে বন্যা ও কাদা ধসে অন্তত ১১ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগ বুধবার ত্রিপুরায় একটি "রেড অ্যালার্ট" সতর্কতা জারি করেছে, রাজ্যের রাজধানী আগরতলা সহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ভারী বর্ষণে প্লাবিত হওয়ার পরে কর্তৃপক্ষ দুই দিনের জন্য স্কুল বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য করেছে।
কর্তৃপক্ষ ত্রিপুরায় ৩০০ টিরও বেশি ত্রাণ শিবির খুলেছে, যেখানে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
সোমবার বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ার পর থেকে ১১ জন মৃতের মধ্যে সাতজন ডুবে গেছে বা পানিতে ভেসে গেছে। এবং চারজন কাদা ধসের কারণে কাদামাটির নিচে চাপা পড়ে
ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা বলেছেন, "আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং বাস্তুচ্যুতদের ত্রাণ পৌঁছানোর দিকে মনোনিবেশ করছি।"
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অমিত শাহ, এক্স-এ একটি পোস্টে বলেছেন যে কেন্দ্রীয় সরকার ত্রিপুরা রাজ্য সরকারকে ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করার জন্য নৌকা এবং হেলিকপ্টার ছাড়াও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দলকে ত্রিপুরায় পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি ও ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (২২ অগাস্ট) বিকেল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৮ জেলায় বন্যায় ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত এবং ফেনী ও কুমিল্লায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের আট জেলা প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কথা উল্লেখ করে অন্তবর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারবিষয়ক উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেছেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে।
তিনি বলেন, “কোনো ধরনের পূর্ব সতর্কবার্তা ছাড়াই এবং আমাদের প্রস্তুতির কোনো সুযোগ না দিয়েই বাঁধটি খুলে দেওয়া হয়েছে।”
বৃহস্পতিবার (২২ অগাস্ট) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন নাহিদ।
তিনি আরও বলেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে এবং অসহযোগিতার পরিচয় দিয়েছে।
নাহিদ বলেন, ভারতের নীতির কারণে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ এবং পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি করছে।
এর আগে আন্দোলনের আরেক নেতা যিনি দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা, আসিফ মাহমুদ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির কথা বলেন।
"কোন নোটিস ছাড়াই ওয়াটার গেইট খুলে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে," মাহমুদ তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন।
মাহমুদ ভারতের কাছ থেকে "স্পষ্ট ব্যাখ্যা" দাবী করেন।
বাংলাদেশে বন্যার জন্য ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধ দায়ী নয়: ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। তবে বন্যার কারণ হিসেবে বাংলাদেশে যা বলা হচ্ছে তা তথ্যগতভাবে সঠিক নয় বলে দাবি দেশটির ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় ত্রিপুরায় বাঁধ খুলে দেয়ার বিষয়ে বৃহস্পতিবার (২২ অগাস্ট) ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, পানির উচ্চতার কারণে অটোমেটিক পানি রিলিজ হয়েছে।
সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এই কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২২ অগাস্ট) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা দেখছি ত্রিপুরার গোমতী নদীর উজানে ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। এটি তথ্যগতভাবে সঠিক নয়।”
বিবৃতিতে বলা হয়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যবর্তী অভিন্ন নদীগুলোতে হওয়া বন্যা দুই দেশের অভিন্ন সমস্যা যা জনগণের দুর্ভোগের কারণ এবং এর সমাধানে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা উল্লেখ করতে চাই যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর অববাহিকা (ক্যাচমেন্ট) এলাকায় কয়েক দিন ধরে এ বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে এ বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকের বৃহৎ অববাহিকার পানির কারণে ঘটেছে।”
যেহেতু দুই দেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে, তাই নদীর পানি সহযোগিতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করে ভারত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা দ্বিপক্ষীয় পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে পানিসম্পদ ও নদীর পানি ব্যবস্থাপনার সমস্যা ও পারস্পরিক উদ্বেগের সমাধান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে বেশ দূরে ১২০ কিলোমিটারেরও বেশি উজানে ডুম্বুর বাঁধের অবস্থান। এটা কম উচ্চতার (প্রায় ৩০ মিটার) একটি বাঁধ। এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ একটি গ্রিডে যুক্ত হয় এবং ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে যায়।
প্রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর অববাহিকায় তিনটি জায়গায় (অমরপুর, সোনামুড়া ও সোনামুড়া–২) পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশন রয়েছে।
বুধবার (২১ অগাস্ট) থেকে পুরো ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে পানির চাপে বাঁধ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছাড়ার ঘটনা দেখা গেছে।
উজানে অমরপুর পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির (প্রটোকল) অংশ হিসেবে। এর আওতায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বন্যাসংক্রান্ত যেকোনো তাৎক্ষণিক তথ্য বাংলাদেশকে দিয়ে থাকে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলছে, “গতকাল (বুধবার) দুপুর ৩টা পর্যন্ত পানিপ্রবাহ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার তথ্য বাংলাদেশকে পাঠানো হয়েছে। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে বন্যার কারণে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার জেরে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটে। আমরা জরুরি তথ্য সরবরাহ নিশ্চিতে অন্য মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা করছি।”
(এই প্রতিবেদনের তথ্য এপি, রয়টার্স ও ইউএনবি থেকে নেওয়া হয়েছে।)