বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। তবে বন্যার কারণ হিসেবে বাংলাদেশে যা বলা হচ্ছে তা তথ্যগতভাবে সঠিক নয় বলে দাবি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
বৃহস্পতিবার (২২ অগাস্ট) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা দেখছি ত্রিপুরার গোমতী নদীর উজানে ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। এটি তথ্যগতভাবে সঠিক নয়।”
বিবৃতিতে বলা হয়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যবর্তী অভিন্ন নদীগুলোতে হওয়া বন্যা দুই দেশের অভিন্ন সমস্যা যা জনগণের দুর্ভোগের কারণ এবং এর সমাধানে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা উল্লেখ করতে চাই যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর অববাহিকা (ক্যাচমেন্ট) এলাকায় কয়েক দিন ধরে এ বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে এ বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকের বৃহৎ অববাহিকার পানির কারণে ঘটেছে।”
যেহেতু দুই দেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে, তাই নদীর পানি সহযোগিতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করে ভারত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা দ্বিপক্ষীয় পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে পানিসম্পদ ও নদীর পানি ব্যবস্থাপনার সমস্যা ও পারস্পরিক উদ্বেগের সমাধান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
ডুম্বুর বাঁধ ১২০ কিলোমিটার উজানে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে বেশ দূরে ১২০ কিলোমিটারেরও বেশি উজানে ডুম্বুর বাঁধের অবস্থান। এটা কম উচ্চতার (প্রায় ৩০ মিটার) একটি বাঁধ। এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ একটি গ্রিডে যুক্ত হয় এবং ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে যায়।
প্রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর অববাহিকায় তিনটি জায়গায় (অমরপুর, সোনামুড়া ও সোনামুড়া–২) পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশন রয়েছে।
বুধবার (২১ অগাস্ট) থেকে পুরো ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে পানির চাপে বাঁধ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছাড়ার ঘটনা দেখা গেছে।
উজানে অমরপুর পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির (প্রটোকল) অংশ হিসেবে। এর আওতায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বন্যাসংক্রান্ত যেকোনো তাৎক্ষণিক তথ্য বাংলাদেশকে দিয়ে থাকে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলছে, “গতকাল (বুধবার) দুপুর ৩টা পর্যন্ত পানিপ্রবাহ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার তথ্য বাংলাদেশকে পাঠানো হয়েছে। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে বন্যার কারণে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার জেরে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটে। আমরা জরুরি তথ্য সরবরাহ নিশ্চিতে অন্য মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা করছি।”
বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি
এদিকে বাংলাদেশের পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আটটি জেলায় ভারি বৃষ্টি আকস্মিক বন্যার অন্যতম কারণ হলেও, দেশটিতে একটা ধারণা প্রবল হয়েছে যে, উজানে পানি ছাড়ার কারণেই বন্যা হচ্ছে।
এই বিতর্কে যোগ দিয়েছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, যারা সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে ৫ অগাস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করেন।
“আমাদের যখন পানির প্রয়োজন আপনারা পানি দিচ্ছেন না,” ভারতের উদ্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অন্যতম হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন। “আবার যখন পানির প্রয়োজন নেই আপনারা বাঁধ খুলে দিয়ে বন্যায় বাংলাদেশের মানুষকে সংকটের মধ্যে ফেলছেন।”
আন্দোলনের আরেক নেতা যিনি দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা, আসিফ মাহমুদ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতির কথা বলেন।
“কোনো নোটিশ ছাড়াই ওয়াটার গেইট খুলে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে,” মাহমুদ তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন।
মাহমুদ ভারতের কাছ থেকে "স্পষ্ট ব্যাখ্যা" দাবী করেন।
বন্যায় ২৯ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত, মারা গেছে ২ জন: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়
বন্যায় বাংলাদেশের আট জেলায় ২৯ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া, মারা গেছে দুজন।
বৃহস্পতিবার (২২ অগাস্ট) সচিবালয়ে চলমান বন্যা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। আট জেলায় মোট ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ৫০ উপজেলা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন ৩৫৭টি। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪ জন।
এ ছাড়া, ফেনীতে একজন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন মারা গেছেন। আট জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে মোট ৪৪৪টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে বলেও জানান তিনি।
পানিবন্দী বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দিতে মোট ১ হাজার ৫৩৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মোট ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন লোক এবং ৭ হাজার ৪৫৯টি পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আলী রেজা বলেন, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি বাড়ছে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের মনু, খোয়াই, ধলাই নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তীতে উন্নতি হতে পারে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য তুলে ধরে আলী রেজা আরও বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা ইত্যাদি নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তীতে উন্নতি হতে পারে।
দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী মজুদ রয়েছে জানিয়ে আলী রেজা বলেন, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতে জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে এক সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২-৫৫১০১১১৫ নম্বর চালু রয়েছে।
ফেনী জেলায় বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। সেনাবাহিনী থেকে ১৬০ জন সদস্য ও ৪০টি উদ্ধারকারী যান ফেনী জেলায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া, একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। নৌবাহিনীর ৭১ জন সদস্য ও ৮টি উদ্ধারকারী যান কাজ করছে।
বিজিবিসহ আরও নৌযান আনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ত্রাণ কার্যক্রমের বিষয়ে- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ নাজমুল আবেদীন বলেন, বন্যা দুর্গত আট জেলায় মোট ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণের চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৩ হাজার ৬৫০ টন। এ ছাড়া, শুকনা ও অন্য খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার পিস।