হাসিনা সরকার পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা- আমরা যা জানি

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার প্রতিবাদে সমাবেশ। ঢাকা, ৯ অগাস্ট, ২০২৪।

"আমি কখনো নিজের বাড়ি ছেড়ে রাতের পর রাত এর ওর বাড়িতে পালিয়ে নির্ঘুম রাত এর আগে কাটাই নি। আমার বাবা আমার সবথেকে প্রিয় মানুষ। বাবা মৃত্যুর রাতটা আমি কখনো ভুলতে পারি না। ডিসেম্বরের প্রচন্ড শীতে লাশ আগলে বসে থাকা সেই রাত... আজকে নিজের মুখে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাবার মৃত্যুর রাতের থেকেও ভয়াবহ রাত এই কদিন কাটিয়েছি, কাটাচ্ছি৷ মৃত্যুভয়ে ধুকে মরছি। তবু বাংলাদেশের মানুষকে কোন মানদন্ডে ফেলে বিচার করব বুঝতে পারছি না। কারণ এরাই আমার বাড়ি এসে হুমকি দিয়ে যায়। এরাই আমার আত্মীয়দের ঘর জ্বালায়। আবার এদের মধ্যেই কেউ কেউ অনেক রাতে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায়। কাল আমি যাদের বাড়ি রাত কাটিয়েছি তারা আমাকে পোলাও মাংস রান্না করে খাইয়েছে। মেহমান এসেছে বলে তাদের বাড়ির সকলে প্রচণ্ড খুশি.. এদের কেউ কেউ আমার বাড়ি পাহারা দিয়েছে।"

"বিশ্বাস করুন, আমি করুণা চাই না। আমি কাউকে ফোন করে আর কখনো বলতে চাই না আমার বাড়িটা প্লিজ একটু পাহারা দিন.."

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন গত ৮ অগাস্ট তার ফেইসবুক পোস্টে তার বিভাগের এক শিক্ষার্থীর উপরের পোস্টটি শেয়ার করেছেন।

কাবেরী গায়েন শেয়ার করার সময় লিখেছেন, "আমার বিভাগের শিক্ষার্থী শ্রাবস্তী বন্দোপাধ্যায় এক এক জনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ'র পরে। নিরাপত্তার জন্য। যারা তাকে দুর্দিনে সাহায্য করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েও তিনি এক সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন : "আমার বাড়ি কেনো পাহারা দিতে হবে?" এই প্রশ্ন আমারও।


অগাস্টের পাঁচ তারিখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রেক্ষিতে এধরণের বেশ কিছু ঘটনার কথা আমরা জানছি।

কী বলছেন মানবাধিকার কর্মীরা?

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "শেখ হাসিনার মতো স্বৈরচারী শাসকের পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তার পাশাপাশি রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক শক্তিগুলো সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যেটা আগে এত অল্প সময়ের ভেতর আমরা দাঁড়াতে দেখিনি। সংখ্যালঘুরা ভিন্ন কোনো গ্রহ বা দেশ থেকে আসেনি। তারা এ দেশেরই সন্তান। আমার যে অধিকার, তারও সেই অধিকার। কিন্তু একটা সুযোগের পেক্ষাপটে দুস্কৃতিকারীরা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করেছে অথবা যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চায় না, তারা করতে পারে। বড় কথা হচ্ছে এই ঘটনার পর ছাত্র থেকে শুরু করে সামাজিক শক্তিগুলো যেভাবে পাশে থেকেছে, সেটি অনেক বড় পরিবর্তন। আমি আশা করি বিষয়গুলো সামনে আর ঘটবে না।"

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত এ প্রসঙ্গে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আগের চেয়ে হামলার সংখ্যা একটু কমেছে। ৫ অগাস্ট থেকে যে হারে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা শুরু হয়েছিল, এখন অতটা নেই।

যারা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করেছে, ঘরবাড়ি লুটপাট করেছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে দাবি তুলে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘আমরা ইতিমধ্যে বলেছি যারা এগুলো করেছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যারা ভূমিচ্যুত হয়েছে তাদের ভুমি ফিরিয়ে দিতে হবে।’’

‘‘আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যত হামলা হয়েছে সবক্ষেত্রে আমরা দায়মুক্তির সংস্কৃতি দেখেছি। নতুন প্রশাসন দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কি না, এখন সেটিই দেখার বিষয়।’’

অগাস্টের ৫ তারিখ থেকে এখন পর্যন্ত কী ঘটেছে?

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর অগাস্টের ৫ তারিখ থেকে সারাদেশে বিভিন্ন জেলায়, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য, তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে ব্যাপক হামলা, অগ্নিসংযোগ, হত্যাকান্ডসহ সহিংসতার ছড়িয়ে পড়ে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়ার পর সহিংসতা অনেকটা কমে এলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (অগাস্ট ১৬) সহিংসতা অব্যাহত আছে।

স্থানীয় মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫ তারিখ, রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে অবস্থিত সংগীতশিল্পী রাহুল আনন্দের বাড়িতে হামলা করা হয়। হামলাকারীরা জলের গান ব্যান্ডের দলনেতা রাহুলের বাসা লুটপাট করে , তাকে তার স্ত্রী ও সন্তানসহ বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং রাহুলের নিজের তৈরী ও সংগ্রহ করা বিপুল পরিমান বাদ্যযন্ত্র সহ পুরো বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।

যদিও পরবর্তীতে রাহুল নিজে, তার স্ত্রী ও স্ত্রীর ব্যাবসায়িক পার্টনার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ও লোকাল মিডিয়াকে জানান যে রাহুলদের বাড়ির ওপর হামলা ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক কারণে হয়নি। ৩২ নাম্বার রোডে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে হামলা ও আগুন লাগাতে গিয়ে পাশের বাড়ি হওয়ায় তাদের বাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে।

ঐদিনই শরীয়তপুরে ধানুকা মনসাবাড়ি মন্দির সহ সারাদেশে বেশকিছু মন্দিরে হামলা করে আগুন লাগানো, লুটপাট সহ ধ্বংসযজ্ঞ হয়। দিনাজপুরের কেন্দ্রীয় শ্মশানঘাটেও চালানো হয় ধ্বংসযজ্ঞ।

দুটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সংগঠন, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসকে অগাস্টের ৯ তারিখ লেখা এক খোলা চিঠিতে জানান যে, তখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারাদেশে ৫২ টি জেলায় কমপক্ষে ২০৫ টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক প্রেস কনফারেন্স চিঠিটি পড়ে শোনান।

চিঠিতে বলা হয়, "অনেক মন্দির হামলার পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অনেক নারী নিগৃহীত হয়েছেন। কয়েকটি স্থানে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। আক্রান্ত হয়েছে অন্য সংখ্যালঘুরাও। মূলত ৫ আগস্ট থেকে এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সারা দেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে গভীর শঙ্কা, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে।"

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকার পতনের দিন ৫ অগাস্ট থেকে ৮ অগাস্ট পর্যন্ত মোট ৫২ জেলায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে এবং এই চারদিনে মৃত্যু হয়েছে চারজনের।

সংগঠনটির পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে চট্টগ্রাম জেলায়। এই জেলায় মোট ১৬টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরপর ময়মনসিংহ জেলায়, ১০টি।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ-জামান সোমবার (১২ অগাস্ট) বলেছেন, দেশের ২০ জেলায় ৩০ টি সংখ্যালঘু সংশ্লিষ্ট অপরাধ সংগঠিত হয়েছে।

সাম্প্রদায়িক এ হামলাগুলোর প্রতিবাদে ৯ তারিখ থেকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকরা প্রতিবাদ সমাবেশ করছে। ১০ তারিখ ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে বিরাট সমাবেশ হয়। সমাবেশ হয় ১১ তারিখও।

যাদের মৃত্যু হয়েছে

সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার পূজা কমিটির নেতা ও সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিককে হত্যা করা হয়েছে।

বাগেরহাটে সদর থানার রাখালগাছী ইউনিয়নের স্কুলশিক্ষক মৃণাল কান্তি চক্রবর্তীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার স্ত্রী ও মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর শাখার সভাপতি শ্রী হারাধন রায়সহ দুই জান মারা গেছেন।

৬ অগাস্ট চট্টগ্রাম লোহাগড়া উপজেলার মছদিয়া গ্রামে বৌদ্ধ শ্মশান দখলের চেষ্টা করা হয়।

একই দিন চট্টগ্রাম রাউজানের পাহাড়তলী মহামুনি বৌদ্ধ গ্রামে হামলা ও ভাঙচুর এর ঘটনা ঘটে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিক্রিয়া

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে এক বৈঠকে মঙ্গলবার (১৩ অগাস্ট) বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে বিভক্ত না হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এক থাকার আহ্বান জানান ড: ইউনূস। ন্যায়বিচার হলে সবাই বিচার পাবে উল্লেখ করে অন্তরবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্য করে বলেন,"ন্যায়বিচার হলে কে বিচার পাবে না, এটা আমাকে বলেন? এটা কি দেখার সুযোগ আছে? কে কোন ধর্মের , কোন জাতের, কোন সম্প্রদায়ের। এটা কি আইনে বলা আছে যে এই ধর্মের, এই সম্প্রদায়গুলো এই আদালতে যাবে, ওই সম্প্রদায়গুলো অন্য আদালতে যাবে? আইন একটা, কার সাধ্য আছে এখানে বিভেদ করে?"

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ১১ অগাস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দাবি করেছেন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সেগুলো ধর্মীয় কারণে নয়। তিনি বলেন, "এসব হামলা ধর্মীয় কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণে।" তবে তিনি এটিও বলেন, "যেকোন কারণেই হোক সহিংসতা মেনে নেয়া যায় না। এটা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয় যে, কোনো একজন ধর্মের কারণে বা তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে নির্যাতিত হবেন "

অগাস্ট-এর ১২ তারিখ, ধর্ম উপদেষ্টা খালিদ হোসেন এক প্রেস ব্রিফিং এ বলেছেন, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে, যারা হামলা করেছে সেসব দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিতের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।

ঐদিনই ধর্ম মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা বা অন্য অন্য কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা হলে তা ধর্ম মন্ত্রণালয়কে ০১৭৬৬ -৮৪৩৮০৯ এই হটলাইনে ফোন বা এস এম এসের মাধ্যমে জানানোর অনুরোধ করে।

বুধবার (১৪ অগাস্ট) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সংখ্যালঘুসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যাক্ত করেন।

শুক্রবার (১৬ অগাস্ট) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে বাংলাদেশের হিন্দুসহ সব সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।


বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে ভারতে প্রতিক্রিয়া

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৫ অগাস্ট দিল্লির লালকেল্লায় ভারতের স্বাধীনতা দিবসে দেয়া তার ভাষণে বলেন ভারতীয়রা বাংলাদেশে সরকার পতনের পর হামলার শিকার হওয়া হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। মোদী বলেন, "১৪০ কোটি ভারতীয়, হিন্দুদের, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। "

তিনি আরও বলেন, "আমরা আশা করি বাংলাদেশে পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে। হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সেদেশে নিশ্চিত হোক ভারতীয়রা সেটারই নিশ্চয়তা চায়।"

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত-- বাংলাদেশ সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ভারত সরকার একটি কমিটি করেছে বলে রিপোর্ট করেছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম, এনডিটিভি। এ কমিটি বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেখানে অবস্থানরত ভারতীয়দের নিরাপত্তা ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে যোগাযোগ রাখবে।

এর আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ডঃ ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার এক এক্স বার্তায় বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্য সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তে নিরাপত্তা জোরালো করে বিএসএফ।

ভারতীয় মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াতে অতিরঞ্জিত ও অপতথ্য প্রচার

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ও ভারত থেকে করা নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একাউন্টগুলোর পোস্টে যে খবর ও তথ্য দেয়া হয়েছে সেগুলোকে অতিরঞ্জিত , ফেইক নিউজ বা অপতথ্য বলে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা, আল জাজিরা, দেশ রূপান্তর সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশী মিডিয়া।

অগাস্ট-এর ১১ তারিখে প্রকাশিত বিবিসি বাংলার রিপোর্টে বলা হয়, বিবিসির ফ্যাক্ট চেকিং বিভাগ বিবিসি ভেরিফাই, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্টার অনেকগুলো যাচাই করে দেখেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলেও অনেক ক্ষেত্রে হামলার গুজবও ছড়ানো হয়েছে।

বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর "ব্যাপক অত্যাচার " হচ্ছে বলে যে মিথ্যা পোস্টগুলো ছড়ানো হয় তা বেশিরভাগই ভারতীয় একাউন্ট থেকে। তবে বাংলাদেশের ভেতর থেকেও এ ধরণের গুজব ছড়ানো হয়েছিল।

শুক্রবার (১৬ অগাস্ট) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার খবর 'অতিরঞ্জিত' করা হয়েছে।

একই সঙ্গে তিনি ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সংখ্যালঘু সুরক্ষার বিষয় নিয়ে সরেজমিনে রিপোর্ট করার জন্য তাদের আমন্ত্রণ জানান।


হামলার কারণ রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক নয়

সাম্প্রতিক হামলাগুলো মূলত রাজনৌতিক কারণে ঘটেছে, সাম্প্রদায়িক কারণে নয়, এ ধরণের দাবি করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান থেকে শুরু করে দেশি বিদেশী সংবাদ মাধ্যম, হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন নেতা ও সদস্য, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী সমর্থক সহ অনেকেই।

তারা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দীর্ঘ পনেরো বছরের ক্ষোভ থেকে ছাত্র জনতা , পতিত সরকার দলীয় আওয়ামী লীগের কর্মী নেতা সমর্থকদের ওপর ও তাদের বাড়িঘর, সম্পদ , ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে। যেহেতু হিন্দু সহ সংখ্যালঘুরা ঐতিহ্যগত ভাবে মূলত আওয়ামী লীগ করে, সরকার পতনের পর তারাও অনেকে জনরোষের মুখে হামলার শিকার হয়েছেন। যেমন হয়েছেন মুসলমান সম্প্রদায়ের আওয়ামী লীগের সদস্য, সর্মথকরা।

এ প্রসঙ্গে সংগীত শিল্পী রাহুল আনন্দের বাড়িতে হামলা হওয়া নিয়ে তার ব্যান্ড জলের গানের অফিসিয়াল ফেইসবুক পেজ থেকে এক পোস্টে ফ্যাশন হাউজ "খুঁতের " অন্যতম সত্ত্বাধিকারী ফারহানা হামিদ দাবি করেছেন যে রাহুল আনন্দের বাড়িতে ওই হামলা সাম্প্রদায়িক কারণে হয়নি।

তিনি দাবি করেন ঐদিনের ওই হামলা হয়েছিল ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বঙ্গবন্ধু মিউজিয়ামে। রাহুল ও তার স্ত্রী "খুঁতের" অন্যতম সত্ত্বাধিকারী উর্মিলা শুক্লার বাড়িটি বঙ্গবন্ধু মিউজিয়ামের দেয়াল ঘেঁষা হওয়ার কারণে পরে সেখানেও আগুন দেয়া হয়।

এ বিষয়ে রাহুল আনন্দ স্থানীয় দৈনিক প্রথম আলোকে বলেন, "দেশের ভিখারি থেকে উঁচুতলার মানুষ আমাকে ভালোবাসে। আমার বাড়িতে আগুন দিতে যায়নি। এখানে হাজার মানুষের মধ্যে অতিউৎসাহীরা এটা করেছে। "

ফারহানা হামিদ আরো লিখেছেন, "রাহুলদাকে উদ্দেশ করে আগুন দিলে তারা এই পরিবারকে এভাবে বেরিয়ে দেবার সুযোগ দিতো না। আর সুযোগ না দিলে সে বাসা থেকে বের হওয়া অসম্ভব। রাহুলদার বাসায় আগুনের সঙ্গে, রাহুলদার ধর্ম, বর্ণ, জাত, সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই।"

সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের তিনি ঘোর বিরোধী জানিয়ে মিজ হামিদ লিখেন , "তার মানে এই নয় যে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, জাত, সংস্কৃতির কারণে আক্রমণ করা হয় নাই কিন্তু কোনো কারণে গুজব ছাড়াচ্ছে আর সে গুজবকে গুজব বলা যাবে না।"

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা , নাহিদ ইসলাম এ প্রসঙ্গে বার্তা সংস্থা এএফপি'কে বলেন, সহিংসতাগুলো যতটা না ধর্মীয় কারণে তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, "এগুলো বাংলাদেশকে বিভক্ত করার জন্য ঘটেছে তবে বাংলাদেশ তাদের (সংখ্যালঘুদের) রক্ষা করবে।"

সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, "দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের সরকার, আপনাদের পাশে দাঁড়াবে।"

দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা হিন্দুদের উপর আক্রমণের দায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের উপর দিতে চাইছেন।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম মঙ্গলবার তাদের চারদফা নতুন দাবি ঘোষণা করতে গিয়ে দ্বিতীয় দফা দাবিতে জানান, "সংখ্যালঘুদের উপর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী মহাজোটের শরিক দলগুলোর পরিকল্পিত হত্যা, ডাকাতি, ও লুন্ঠনের মাধ্যমে গণঅভুথ্যানকে বিতর্কিত করার প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে ও সংখ্যালঘুদের দাবি মানতে হবে।"

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৪ অগাস্ট ঠাকুরগাঁওয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপের সময় দাবি করেন যে, "ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে নস্যাৎ করতেই, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের একটা চক্র পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে মাইনোরিটি নির্যাতনের একটা অলীক কাহিনী প্রচার করে আসছে।"