পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ঃ রাজশাহীতে ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলাটা 'অত্যন্ত দুঃখজনক'

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়

রাজশাহীতে বরেণ্য পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনাটি 'অত্যন্ত দুঃখজনক' বলে বর্ননা করেছেন ভারতের চলচ্চিত্র অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের নাতি।

ঘটনাটা আমার গোচরে এসেছে, কানে এসেছে এবং আমি পড়েছি। ইন ফ্যাক্ট, বাংলাদেশের অনেক বন্ধুরাই আমাকে এটা পাঠিয়েছেন, অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে। এমন মানুষও পাঠিয়েছেন যারা এই ছাত্রদের আন্দোলন ভীষণভাবে সমর্থন করেছেন।

বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, "ঘটনাটা আমার গোচরে এসেছে, কানে এসেছে এবং আমি পড়েছি। ইন ফ্যাক্ট, বাংলাদেশের অনেক বন্ধুরাই আমাকে এটা পাঠিয়েছেন, অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে। এমন মানুষও পাঠিয়েছেন যারা এই ছাত্রদের আন্দোলন ভীষণভাবে সমর্থন করেছেন।"

"ঋত্বিক ঘটকের বাড়ির ব্যাপারে এটুকু বলতে পারি যে বাড়িটি অনেকদিনই পরিবারের আওতায় ছিল না। ওটি একটি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসালয় ছিল এবং আংশিকভাবে অলরেডি অন্য লোকেদের দখলে ছিল। পরিবারের নিয়ন্ত্রণ ছিল না কখনই ওটার ওপর। কিন্তু তার সত্ত্বেও বলছি, ওটা ভেঙ্গে ফেলাটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এইটুকু বলতে পারি।"

এরশাদ আমলে ১৯৮৯ সালে সরকার এই বাড়ি ও সংলগ্ন জমির ৩৪ শতাংশ রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে ইজারা দেয়। রাজশাহী জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালে বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নেয়। বাড়িটির ইজারা বাতিল করে ঋত্বিক ঘটকের নামে দেয়ার জন্য আবেদন করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ভবনের দক্ষিণ অংশে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত পুরনো বাড়ির একটি অংশ দাঁড়িয়ে ছিল।

বাড়ি ভেঙে ফেলার বিষয়টি হাসিনা সরকার পতনের পর বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে সাম্প্রতিক অবনতি তার প্রতিফলন বলে মনে করছেন পরমব্রত। সেই সাথে, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনকে তিনি সমর্থন করেছেন বলেও জানান।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, "এই ছাত্রদের আন্দোলন, যেটাকে আমিও - আন্দোলন চলাকালীন তাদের যে উদ্যম, তাদের যে স্পিরিট, এবং তারা যে দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি চাইছিলেন যেটাকে আমি সমর্থন করেছি - সেটার পরবর্তী সময়তে আমরা অনেক জায়গাতে অনেক রকম অরাজকতা দেখতে পাচ্ছি।

আমি ধরে নেব যে এটা সেই অরাজকতারই একটা প্রতিফলন...এই গুলোর থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পাবে বলে আশা করব। আর যদি সেটা না হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে এই আন্দোলনের সঙ্গে পাশাপাশি আরও একটা কোথাও একটা বড় টেক্টনিক শিফট ঘটেছে যেটা হয়তবা কাঙ্খিত ছিল না।

"আমি ধরে নেব যে এটা সেই অরাজকতারই একটা প্রতিফলন, যেটা আশা করব আগামীতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর তারা যখন সম্পূর্ণভাবে কাজ করতে আরম্ভ করবেন, বা যখন আইন শৃঙ্খলা সিচুয়েশন, পরিস্থিতি যখন বেটার হবে, তখন এই গুলোর থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পাবে বলে আশা করব। আর যদি সেটা না হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে এই আন্দোলনের সঙ্গে পাশাপাশি আরও একটা কোথাও একটা বড় টেক্টনিক শিফট ঘটেছে যেটা হয়তবা কাঙ্খিত ছিল না। জানিনা, সেটা তো সময়ই বলবে," তিনি বলেন।

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের শুরুটা কেটেছে রাজশাহীর এই পৈতৃক বাড়িতে। তিনি যখন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও পরে রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করছিলেন তখন তিনি এই বাড়িটাতেই থেকেছেন। ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীও এই বাড়িতে থেকে গেছেন।

এই সপ্তাহে নগরের ঘোড়ামারা মহল্লার মিয়াপাড়ায় অবস্থিত বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে বুধবার (১৫ আগস্ট) রাজশাহীর সংস্কৃতিকর্মীরা সেখানে যান এবং এর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানান।

ঠিকাদারের দাবী কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।

তবে বাংলাদেশের একটি জাতীয় গণমাধ্যমকে কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেছেন, "৬ আগস্ট অফিস খোলার দিন ...বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা এখানে আসেন। তারা বলতে থাকেন বঙ্গবন্ধুর ছবিটা নামিয়ে নিতে। তখন তারা ব্যানারগুলো নামিয়ে ফেলেন। শিক্ষার্থীরা তখন বলেন, এই জায়গাটা ভেঙে ফেলতে হবে। তখন তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এটা কেন ভেঙে ফেলতে হবে?’ পরে সেদিনের মতো শিক্ষার্থীরা চলে যান। পরে সেদিন রাত আটটায় তিনি ফোনে জানতে পারেন, এ বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে। তখন এসে দেখেন, ছয় থেকে সাত জন শ্রমিক এটা ভাঙছেন। শ্রমিকেরা তাকে জানিয়েছেন, কয়েকজন তাদের টাকা দিয়ে এটা ভাঙতে বলেছেন। ছাত্ররা এটা করিয়েছেন। তার ইন্ধনে এটা হয়নি। কারণ, এ জায়গাটা তারা হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোর হিসেবে ব্যবহার করেছেন।"

বুধবার পরে ঘটনার তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গদবন্ধু জাদুঘরে হামলা হয় ও তাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

পাঁচ অগাস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সারা দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের বাসভবনে হামলা এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরসহ শত শত ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হাসিনার পতনের পরের দুই দিনে দেশে অন্তত ২৩২ নিহত হয় বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ-জামান মঙ্গলবার (১৩ অগাস্ট) বলেছেন, বাংলাদেশের ২০ জেলায় ৩০টি সংখ্যালঘুসংশ্লিষ্ট অপরাধ সংগঠিত হয়েছে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি শুক্রবার (৯ অগাস্ট) খোলাচিঠি দেয়। চিঠিতে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতার সময় ৫২টি জেলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। দেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে শঙ্কা, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে।

এত বড় একটা ঘটনা ঘটার পর কিছু জায়গায় - মানে পাশাপাশি একটা কেয়সও চলতে থাকে, সেটা আমরা জানি। ইতিহাস সাক্ষী সেটার।...এবার আগামীতে দেখতে হবে যে এটা রীতি হয়ে দাঁড়ায় কিনা। আশা করি দাঁড়াবে না।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে পরমব্রত বলেন, "বারবারই অন্তর্বর্তী সরকারের যারা উপদেষ্টা তাদের কথা শুনছি ইউটিউবে-এ, তাদের বার্তা শুনছি, ছাত্র প্রতিনিধি যারা তাদের বার্তা শুনছি যে তারা চেষ্টা করছেন নানা ভাবে সব রকমের অরাজকতা এবং বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন আটকানোর। হয়ত কোথাও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকছে এখনো, কেন না এরম একটা এত বড় একটা ঘটনা ঘটার পর কিছু জায়গায় - মানে পাশাপাশি একটা কেয়সও চলতে থাকে, সেটা আমরা জানি। ইতিহাস সাক্ষী সেটার। তো সেটারই একটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ফলশ্রুতি হিসেবে এটাকে আপাতত আমি দেখব। এবার আগামীতে দেখতে হবে যে এটা রীতি হয়ে দাঁড়ায় কিনা। আশা করি দাঁড়াবে না।"

১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় ভারতে চলে যায় ঋত্বিক ঘটকের পরিবার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাহায্য সংগ্রহে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি 'দুর্বার গতি পদ্মা' নামে তিনি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের বোন প্রতীতি দেবীর শ্বশুর ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে প্রথমে গ্রেফতার ও পরে হত্যা করা হয়।