মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের ৬০০ ভাস্কর্য ভাঙচুর

কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ মুজিবনগর কমপ্লেক্সে হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ ৬০০টি ছোট-বড় ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে।

স্বাধীনতার সূতিকাগার ঐতিহাসিক মুজিবনগর কমপ্লেক্সে এখন সুনসান নীরবতা। একসময় পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হওয়া মুজিবনগরের আম্রকানন এখন জনমানবহীন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের দিন বিকালে এই ঐতিহাসিক স্থানটিতে শুরু হয় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট।

কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ ৬০০টি ছোট-বড় ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে। জন আক্রোশের মুখে প্রাণভয়ে পালিয়ে যান নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যরা। ছাত্র-জনতার তোপের মুখে তারা পালিয়ে আশ্রয় নেন তাদের ব্যারাকে। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় জানা যায়, দেশীয় অস্ত্র, বাঁশ, রড, হাতুড়ি নিয়ে স্মৃতি কমপ্লেক্সের এসব ভাস্কর্যের ওপর হামলা চালালানো হয়।

মুজিবনগরে ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল, মুজিবনগর কমপ্লেক্সে জাতির স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রতীক। ১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকার এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করে। আওয়ামী লীগ সরকার পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে স্থানটি সম্প্রসারিত করে, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করে, এবং সেখানে ম্যুরাল এবং ভাস্কর্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তর্জনী উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের ভাস্কর্যটির মাথা ও হাত ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া, ১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে।

দ্বিতীয় দফায় রাতে এসে কমপ্লেক্সের মধ্যে দেশের মানচিত্রের আদলে তৈরি করা মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরে যুদ্ধের বর্ণনা সংবলিত ছোট ভাস্কর্যগুলো ভেঙে আশপাশে ছুড়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা। কমপ্লেক্সের পেছনে জয় বাংলা তোরণের ‘জয় বাংলা’ লেখাটিও খুলে নিয়ে যায় তারা।

১৭ এপ্রিলের গার্ড অফ অনার, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলা হয়। এসময় শহীদ স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকটি ভেঙে নিয়ে যায় তারা।

সোমবার (১২ আগস্ট) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ‘ম্যাপ অফ বাংলাদেশ'-এর সামনে কয়েকজন আনসার সদস্য পাহারা দিচ্ছেন; কিন্তু মূল ফটক এখনো অরক্ষিত। দায়িত্বরত ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য, ল্যান্স করপোরাল আজিম উদ্দিন ও আনসার সদস্য সোলাইমান বলেন, এখানে ছোট-বড় ৬০০টি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ ছিলো এই ভাস্কর্যগুলো।

ব্যাটালিয়ন আনসার কমান্ডার সুবেদার রবিউল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্ট বিকালের দিকে হামলাকারীরা কমপ্লেক্সে ঢুকে শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করে চলে যায়। পরে, আবার রাতে এসে মধ্যরাত পর্যন্ত ভাঙচুর চালায়।

তিনি আরো জানান, হামলাকারীরা আনসার ক্যাম্পেও আক্রমণ করে। অফিস ভাঙচুর করে কন্ট্রোল রুম থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার হার্ডডিস্কটি খুলে নিয়ে যায় তারা। রবিউল ইসলাম বলেন, “দুর্বৃত্তদের হামলার সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মুঠোফোনে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিলো। তিনি কোনো নির্দেশনা দিতে পারেননি। এ কারণে আনসার সদস্যরা নিজেদের জীবন ও অস্ত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যারাকে অবস্থান নেন।”

তিনি আরো বলেন, এই ঘটনার পর মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে দর্শনার্থী আসছেন না। আনসার সদস্যরাও ডিউটি করতে ভয় পাচ্ছেন। আগের চার জনের স্থলে এখন তিন জন করে ডিউটি করছে বলে জানান তিনি।

পাঁচই আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর সহ শত শত ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১০ আগস্ট, ২০২৪।

জুলাই মাসের এক তারিখে সরকারী চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবীতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দু’সপ্তাহের মধ্যে ব্যাপক গণবিক্ষোভে পরিণত হয়। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থদের সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে প্রায় ৩০০জন নিহত হয়ে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়।

শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ছাত্রদের নেতৃত্বে এক গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। সেদিন বিকালে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তাঁরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৯ আগস্ট বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করে।

পাঁচই আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সারা দেশ জুড়ে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের বাসভবনে হামলা এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর সহ শত শত ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হাসিনার পতনের পরের দু’দিনে দেশে অন্তত ২৩২ নিহত হয় বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।