রাশিয়ার ভেতরে ইউক্রেনের ত্বরিত অভিযানের উদ্দেশ্য কী হতে পারে?

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ করা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রুশ বাহিনীর গোলন্দাজ ইউনিট কুরস্কের সুদঝান্সকি অঞ্চলে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফটোঃ ৯ অগাস্ট, ২০২৪।

রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের দ্রুত আক্রমণ ছিল প্রায় আড়াই বছরের যুদ্ধে সীমন্তের ওপারে কিয়েভ বাহিনীর সবচেয়ে বড় হামলা। এই আক্রমণ রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়ে ক্রেমলিনকে বড় আঘাত দিয়েছে।

হঠাৎ করে শুরু হওয়া এই অভিযান প্রতিহত করতে রুশ সামরিক বাহিনীর বেশ বেগ পেতে হচ্ছে, যার ফলে হাজার হাজার বেসামরিক লোকজনকে এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

ইউক্রেনের জন্য, এই হামলা জনগণের মনোবল চাঙ্গা করার সুযোগ সৃষ্টি করছে এমন সময়ে, যখন দেশের সশস্ত্র বাহিনী জনবল এবং সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে ১,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রণাঙ্গন জুড়ে রাশিয়ার অবিরাম আক্রমণের মুখে পড়েছে।

ইউক্রেনের আক্রমণ এবং তার প্রভাব কী হতে পারে? এখানে দেখা যাকঃ

ইউক্রেনের হামলার শুরু যেভাবে

গত মঙ্গলবার (৬ অগাস্ট) ইউক্রেনের সৈন্যরা কুরস্ক অঞ্চলের সাথে ইউক্রেনের ২৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের কয়েক দিক থেকে ঢুকে পরে। তারা কয়েকটি চেকপোস্ট এবং রুশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাল্কা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত দখল করে নেয়।

এর আগে রাশিয়ার ভেতরে ইউক্রেন বাহিনীর হামলায় রুশ স্বেচ্ছাসেবকরা জড়িত থাকতো। কিন্তু এবারের অভিযানে ইউক্রেনীয় সেনা বাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধ-পরীক্ষিত ব্রিগেডের ইউনিট অংশ নিচ্ছে।

কুরস্কের বাসিন্দারা তুলা রেল স্টেশনে পৌঁছানোর পর রুশ জরুরী অবস্থা মন্ত্রণালয়ের স্বেচ্ছাসেবক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং মনস্তত্ত্ববিদ তাদের দেখা শোনা করেন। ফটোঃ ৯ অগাস্ট, ২০২৪।

রুশ সামরিক ব্লগাররা বলছে, কয়েকটি সাঁজোয়া যান নিয়ে ইউক্রেনের একেকটি গ্রুপ দ্রুত কয়েক ডজন কিলোমিটার গভীরে ঢুকে পরে, এবং অঞ্চল জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক দ্য ইন্সটিটিউট ফর স্টাডি অফ ওয়ার বলছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী ৩৫ কিলোমিটার গভীরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়েছে। “দেখে মনে হচ্ছে, সীমান্ত অঞ্চলে রুশ বাহিনী খুব কম থাকায়, ইউক্রেনীয় বাহিনী ছোট সাঁজোয়া বহর দিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ পাশ কাটিয়ে হামলা চালাতে সক্ষম হচ্ছে,” তাদের বিশ্লেষণে বলা হয়।

ইউক্রেনীয় বাহিনীর ছোট ছোট গ্রুপ কোন এলাকা দখল করে না রেখে অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য সৈন্যরা সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে সুদযহা শহরের আসে-পাশে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করছে।

রাশিয়ার জবাব

অতর্কিত হামলায় অবাক হয়ে রাশিয়ার সৈন্যরা দ্রুত কোন জবাব দিতে পারেনি। রুশ সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ পূর্ব ইউক্রেনের ডনব্যাসের অভিযানে নিয়োজিত, যার ফলে কুরস্ক সীমান্ত অঞ্চল পাহারা দেয়ার জন্য খুব কম সৈন্য মোতায়েন ছিল।

লোকবলের অভাবের কারণে রুশ সামরিক বাহিনীর কমান্ডাররা প্রাথমিক পর্যায়ে ইউক্রেনের আক্রমণ আটকাতে জঙ্গি বিমান এবং হেলিকপ্টারের উপর নির্ভর করছিল। রাশিয়ার সামরিক ব্লগাররা জানায়, অগ্রসরম্যান ইউক্রেনীয় সৈন্যরা অন্তত একটি রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত এবং আরেকটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ করা ভিডিও থেকে নেয়া এই স্থির চিত্রে কুরস্ক রণাঙ্গনে একটি রুশ বিমান বাহিনীর এসইউ-৩৪ বিমান থেকে পাখা-যুক্ত নিয়ন্ত্রত বোমা ফেলতে দেখা যাচ্ছে। ফটোঃ ৯ অগাস্ট, ২০২৪।

বাড়তি সৈন্য, যাদের মধ্যে বিশেষ বাহিনী এবং যুদ্ধ-পরীক্ষিত ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধা রয়েছে, পরের দিকে কুরস্ক অঞ্চলে আসতে শুরু করে। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত সুদযহা এবং অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ইউক্রেন বাহিনী সরাতে পারেনি।

শুক্রবার (৯ অগাস্ট) রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয় যে, চার দিনের লড়াই-এ ইউক্রেনের ৯৪৫ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। এই দাবী স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয় নি। রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে মন্ত্রণালয় কোন তথ্য দেয় নি।

ইউক্রেন কী বলছে

ইউক্রেনের কর্মকর্তারা সীমান্তের ওপারে অভিযান সম্পর্কে কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত আছেন। বৃহস্পতিবার (৮ অগাস্ট) রাতে এক ভিডিও বার্তায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি কুরস্ক অঞ্চলের লড়াই সরাসরি উল্লেখ করেন নি। তবে তিনি বলেন যে, “রাশিয়া আমাদের মাটিতে যুদ্ধ নিয়ে এসেছে, এবং তাদের উচিত টের পাওয়া তারা কী করেছে।”

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকির উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক। ফাইল ফটোঃ ২৫ জুলাই, ২০২৪।

জেলেন্সকির উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক বৃহস্পতিবার বলেন যে, সীমান্তের ওপারে হামলার ফলে রাশিয়া “বুঝতে শুরু করবে যে যুদ্ধ ধীরে ধীরে তাদের দেশে ঢুকে পড়ছে।” তিনি আরও বলেন, মস্কোর সাথে ভবিষ্যতে কোন দরকষাকষিতে এ’ধরনের অভিযান কিয়েভের হাত শক্তিশালী করবে।

“আলোচনার প্রক্রিয়া কখন এমনভাবে চালানো সম্ভব হবে, যে তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবো বা তাদের কাছ থেকে কিছু পাবো? শুধুমাত্র যখন যুদ্ধ তাদের পরিকল্পনামাফিক চলছে না,” তিনি বলেন।

ক্রেমলিন কী বলছে?

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হামলাকে একটি “বড় পরিসরে উস্কানি” বলে অভিহিত করে বলেছেন আক্রমণে “নির্বিচারে বেসামরিক ভবন, মানুষের বাসভবন এবং অ্যাম্বুলেন্সের উপর গোলাবর্ষণ” করা হয়েছে।

রুশ কর্তৃপক্ষ বলেছে দুজন অ্যাম্বুলেন্স কর্মী সহ অন্ততপক্ষে পাঁচজন বেসামরিক লোক কুরস্কে ইউক্রেনীয় হামলায় নিহত হয়েছে এবং প্রায় ৭০জন আহত হয়েছে।

রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপ-প্রধান ডিমিত্রি মেডভেডেভ বলেন যে, ইউক্রেনীয় আক্রমণ যুদ্ধে রাশিয়ার লক্ষ্য সম্প্রসারণ করার পক্ষে যুক্তি জোরদার করছে। তিনি বলেন রাশিয়ার উচিত হবে রাজধানী কিয়েভ, কৃষ্ণসাগরের বন্দর ওডেসা এবং অন্যান্য শহর সহ ইউক্রেনের আরও এলাকা দখল করা।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফটোঃ ৯ অগাস্ট, ২০২৪।

রাশিয়া কুরস্ক অঞ্চলে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে, যার ফলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত পাল্টা জবাব সমন্বয় করার ক্ষমতা পাবে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মাধ্যম বাস্তচ্যুত বাসিন্দাদের সহায়তা করতে ক্রেমলাইনর প্রচেষ্টা ফলাও করে প্রচার করছে, কিন্তু আক্রমণের জন্য সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়ে খুব বেশি বলছে না।

ইউক্রেনের লক্ষ্য কী?

অভিযান চালিয়ে কিয়েভ হয়তো চাইছে রাশিয়া যাতে পূর্বে দনেতস্ক অঞ্চল থেকে সৈন্য-সরঞ্জাম সরিয়ে আনে। পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায় রাশিয়া তাদের বেশি অস্ত্র-সরঞ্জামের উপর নির্ভর করে ধীর কিন্তু স্থির গতিতে অগ্রসর হচ্ছে।

কিয়েভের বাহিনী যখন পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে পারছে না, তখন কুরস্ক অঞ্চলে তড়িৎ হামলা দেখালো ইউক্রেন চালকের আসনে বসে যেতে সক্ষম। এই অভিযান দেশের সীমান্ত রক্ষা করতে রাশিয়ার ব্যর্থতা প্রকাশ করে ক্রেমলিনকেও বড় আঘাত দিয়েছে।

কিন্তু প্রাথমিক কিছু সাফল্যের পরও, রাশিয়ার ভেতরে অভিযান থেমে গিয়ে পাল্টা-পালটি যুদ্ধে পরিণত হতে পারে, যেখানে ইউক্রেনের সেরা সামরিক ইউনিটগুলো আটকে যেতে পারে। ফলে, দনেতস্কে যুদ্ধরত সৈন্যদের জন্য বাড়তি লোকবল পাঠানো সম্ভব নাও হতে পারে।

কুরস্ক অঞ্চলে স্থায়ী দখল প্রতিষ্ঠা করা ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য কঠিন হবে। কারণ, তাদের রশদ সরবরাহ করার পথ রুশ আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকবে।