শেখ হাসিনা: ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রথমবারের মত নীরবতা ভাঙলেন

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সম্পাদকের নোটঃ আমাদের এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'র ছেলে সজীব ওয়াজেদ দাবী করেছেন, সম্প্রতি তার মায়ের পদত্যাগের যে খবর বেরিয়েছে তা "সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।" ওয়াশিংটন সময় রবিবার (১১ আগস্ট) দুপুর ১টার দিকে সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ তিনি এ দাবী করেন।

এক্স-পোস্টে বলা হয়, "সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত আমার মায়ের পদত্যাগের বিবৃতি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমি তার কাছ থেকে নিশ্চিত হয়েছি যে তিনি ঢাকা ছাড়ার আগে বা পরে কোনো বক্তব্য দেননি।"


দ্য প্রিন্ট -এর পাশাপাশি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম, এনডিটিভি, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ইকনমিক টাইমস, হিন্দুস্তান টাইমস ও বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো তাদের অনলাইন সংস্করণে শেখ হাসিনার বার্তার প্রেক্ষিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

------------------------------

ছাত্রদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগের পর এই প্রথম মুখ খুললেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মত বিদেশি শক্তি জড়িত ছিল বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।

ভারতের সংবাদমাধ্যম 'দ্য প্রিন্ট' রবিবার (১১ আগস্ট) তার প্রতিবেদনে বলেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনার দেয়া একটি বার্তা তাদের হাতে এসেছে। সেই বার্তায় তিনি বলেছেন, "আমি যদি সেন্ট মার্টিন ও বঙ্গোপসাগর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দিতাম তাহলে আমি ক্ষমতায় থাকতে পারতাম।"

এর আগে, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শেখ হাসিনা এ বছরের ২৩ মে অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের কিছু অংশ আলাদা করে পূর্ব তিমুরের মতো একটি 'খ্রিষ্টান' জাতি-রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে।

সেসময় তিনি আরও দাবি করেন যে, তিনি যদি বাংলাদেশে একটি বিমানঘাঁটি স্থাপনের জন্য একটি দেশকে অনুমতি দিতেন তবে গত জানুয়ারিতে তাকে ঝামেলামুক্ত পুনর্নির্বাচনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করলেও, বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশীয় মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করেই এ বক্তব্য দিয়েছেন।

শেখ হাসিনা বলেন, "অফারটি এসেছে একজন সাদা মানুষের কাছ থেকে।... আমি যদি একটি নির্দিষ্ট দেশকে বাংলাদেশে একটি বিমানঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি দিতাম, তাহলে আমার কোনো সমস্যা হতো না," তিনি যোগ করেন।

এ বিষয়ে ১০ জুন ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডনাল্ড লুকে যুক্তরাষ্ট্র কখনও বাংলাদেশে একটি বিমানঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, "এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। নির্বাচনের সময় আমাদের অগ্রাধিকার ছিল শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশের সাথে কাজ করা।"

হাসিনা সরকারের সাথে বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল লক্ষণীয়। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বহুবার প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও অবস্থানের সমালোচনা করেছেন।

শেখ হাসিনা তার সাম্প্রতিক বার্তায় নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে এই ধরনের বিদেশি শক্তি দ্বারা "ব্যবহৃত" না হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর।

বিদেশি শক্তির জড়িত থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছে না ভারত

ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে তাদের ৭ আগস্টের প্রতিবেদনে বলেছে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশের অস্থিরতায় বিদেশি শক্তির জড়িত থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেননি তবে তিনি সংবেদনশীল ইস্যুটিতে স্পষ্ট বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।

বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধীর একটি প্রশ্নের জবাবে বিদেশি শক্তির ভূমিকা নিয়ে, জয়শঙ্কর সতর্কতার সাথে বলেছেন যে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে তিনি দ্ব্যার্থহীনভাবে কিছু বলতে পারছেন না।

ঐদিন এস জয়শঙ্কর ভারতের রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ বিষয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে রাহুল গান্ধীসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা এই বিষয়ে ভারত সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ শ্রিংলা সোমবার (৫ আগস্ট) বলেছিলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পেছনে 'বিদেশি হাত' থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। হর্ষ শ্রিংলা বাংলাদেশে ও পরে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন।

সোমবার তিনি আরও বলেন, বিদেশি শক্তির জড়িত থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না বিশেষ করে যারা বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী। এছাড়া, যারা "ঘোলা পানিতে মাছ শিকার" করতে চায় তাদের জড়িত থাকার বিষয়টিও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

তবে তিনি সেসময় আরও বলেন, ভারতের স্বার্থেই বাংলাদেশে শান্তি ফিরে আসা দরকার। এবং বাংলাদেশে ক্ষমতায় যেই থাকুক ভারত তাদের সাথে কাজ করবে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণভবনে ছাত্রজনতার উল্লাস। ৫ আগস্ট, ২০২৪।

'আমি পদত্যাগ করেছি যাতে আমাকে লাশের মিছিল দেখতে না হয়'ঃ শেখ হাসিনা

জুলাই মাসের এক তারিখে সরকারী চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবীতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দু’সপ্তাহের মধ্যে ব্যাপক গণবিক্ষোভে পরিণত হয়। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থদের সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে প্রায় ৩০০জন নিহত হয়ে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়।

আন্দোলন ও পদত্যাগ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক বার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, “আমি পদত্যাগ করেছি যাতে আমাকে লাশের মিছিল দেখতে না হয়। তারা আপনাদের (ছাত্রদের) লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল, আমি তা করতে দেইনি। আমি ক্ষমতা ছেড়ে এসেছি।”

তিনি আরো বলেন, "হয়তো আজ যদি আমি দেশে থাকতাম তাহলে আরো প্রাণহানি হতো, আরো সম্পদ ধ্বংস হয়ে যেত।...আমি শীঘ্রই ফিরে আসব ইনশাআল্লাহ। পরাজয় আমার কিন্তু জয় হয়েছে বাংলাদেশের জনগণের।"

“আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম, আমি এসেছিলাম তোমাদের জয় নিয়ে, তোমরাই ছিলে আমার শক্তি, তোমরা যখন আমাকে আর চাওনি, আমি নিজেই তখন চলে গেলাম, পদত্যাগ করলাম।"

শুক্রবার (১০ আগস্ট) বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাথে ওয়াশিংটন থেকে কথা বলার সময় শেখ হাসিনা এই সপ্তাহে ভারতে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেননি বলে দাবী করেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ।

রয়টার্সকে তিনি শুক্রবার বলেন, "আমার মা কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি। তিনি সময় পাননি।...সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।"

সাম্প্রতিক বার্তায় ছাত্রদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন “আমি তরুণ ছাত্রদের কাছে আবারো বলতে চাই, আমি তোমাদের কখনো রাজাকার বলিনি...আমার কথাগুলো বিকৃত করা হয়েছে। আপনাদের বিপদের সুযোগ নিয়েছে একটি মহল।"

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখার বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা (কোটা সুবিধা) পাবে, নাকি রাজাকারদের নাতি-নাতনিরা পাবে?"

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং শেখ হাসিনার ওই মন্তব্যকে তারা তাদের উদ্দেশে করা হয়েছে বলে মনে করে। গভীর রাতে তারা মিছিল করে স্লোগান দিতে থাকে, “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!, কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!" এবং “চাইতে গেলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার।”

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকার ধানমণ্ডির ৪২ নং -এ বঙ্গবন্ধু জাযুঘরে হামলা হয় ও বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ১০ আগস্ট, ২০২৪

বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর সহ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাসভবন ও অন্যান্য ভবনে হামলা

পাঁচই আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সারা দেশ জুড়ে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের বাসভবনে হামলা এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর সহ শত শত ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হাসিনার পতনের পরের দু’দিনে দেশে অন্তত ২৩২ নিহত হয় বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।

নিজ দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে সাম্প্রতিক বার্তায় তিনি বলেন, "আমার কর্মীরা যারা আছেন, কেউ মনোবল হারাবেন না। আওয়ামী লীগ বারবার উঠে দাঁড়িয়েছে।"

শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ছাত্রদের নেতৃত্বে এক গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। সেদিন বিকালে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তাঁরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৯ আগস্ট বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করে।