সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করল বাংলাদেশ সরকার

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিকালে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ এর ১৮ ধারা অনুযায়ী ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়।

শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস রূপ নেওয়ার পর অনেকের প্রাণহানি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ করে আসছে আওয়ামী লীগ সরকার।

সোমবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সর্বসম্মতিক্রমে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের সুপারিশ করে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জামায়াত-শিবির ও বিএনপি কোটা সংস্কারের জন্য ছাত্রদের আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দেশব্যাপী সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন।

আন্ডার গ্রাউন্ডে গেলে জামায়াত-শিবির মোকাবিলার প্রস্তুতি আছে: আইনমন্ত্রী

নিষিদ্ধের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে মোকাবিলার প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে বলে বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।

আইনমন্ত্রী বলেন, "তারা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আন্ডার গ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে। অনেক দলের কী হয়েছে, সেটা আপনারা জানেন। তবে সেটাকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি আমাদের আছে।"

এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনও আমরা সংশোধন করার ব্যবস্থা করেছি। নিষিদ্ধ করার পরেও তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না এমনটি নয়। হয়তো নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আর সাজার মধ্যে আসবে না।

দলটির সম্পদের বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, সেগুলোরও ব্যবস্থা হবে। সেটা আইনে আছে।

দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, "এই দলের অধীনে তারা রাজনীতি করতে পারবে না। বাংলাদেশের কোনো আইনে তারা অপরাধ করলে সেটার বিচার হবে। আপনারা যদি বলেন গণহারে যারা জামায়াত ইসলামীর নতুন কর্মী রয়েছেন, ১৯৭১ এর পরে যারা জন্ম নিয়েছেন তাদের বিচার করা হবে- এরকম গণহারে বিচার করা হবে না।"

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলটির ওপর এটি দ্বিতীয় নিষেধাজ্ঞা এবং এর সদস্যরা হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের অভিযোগে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে।

জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য যেহেতু ধর্ম, তাই স্বাধীন বাংলাদেশে দলটির সাংগঠনিক অস্তিত্ব কার্যত বিলীন হয়ে যায়।

কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে।

১৯৭৬ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি এ এস এম সায়েম এক অধ্যাদেশ জারি করে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।

তবে জামায়াতে ইসলামী তাৎক্ষণিকভাবে জামায়াতে ইসলামী নামে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করেনি। পরিবর্তে, তারা একটি ভিন্ন রাজনৈতিক দল বেছে নিয়েছে।

১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দল ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠন করে। জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা এই দলে যোগ দিয়ে রাজনীতি শুরু করে।

ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন নেতা ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেন এবং ছয়টি আসনে জয়লাভ করেন।

এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রবেশ করেন।

১৯৭৯ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ মে ঢাকার ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে দলের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সম্মেলনে দলটির নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদিত হয়।

এরপর ১৯৭৯ সালের ২৭ মে চার দফা কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে জামায়াতে ইসলামী।

এরপর থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে সভা-সমাবেশ করে আসছিল দলটি।

জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসনে জয়লাভ করে।

তৎকালীন বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। সেসময় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন ছাড়া বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব ছিল না।

তখন থেকেই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়।

২০০৮ সালের পর জামায়াত

২০০৮ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

এরপর নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার শুরু হয়।

এই বিচারে গোলাম আযমসহ জামায়াতে ইসলামীর অনেক শীর্ষ নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। গোলাম আযমকে দেওয়া হয় ৯০ বছরের কারাদণ্ড। এই কারাদণ্ডাদেশ নিয়ে কারাগারেই মারা যান গোলাম আযম।

এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য শীর্ষ নেতারা হলেন- মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।