সমন্বয়কদের বিবৃতি দিতে বাধ্য করার অভিযোগ ভিত্তিহীন গুজব’, দাবি অতিরিক্ত কমিশনার হারুনের

ডিবি কার্যালয়ের প্রধান ফটকে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ডিএমপি অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন-অর-রশীদ। ২৯ জুলাই, ২০২৪।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে ‘নিরাপত্তা ও জিজ্ঞাসাবাদের’ জন্য যারা ডিবি হেফাজতে আছেন, তাদের শিগগিরই ছেড়ে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন-অর-রশীদ।

আন্দোলন বন্ধ করার জন্য ছয় সমন্বয়ককে 'বিবৃতি দিতে বাধ্য করা' হয়েছে এমন দাবিকে 'ভিত্তিহীন গুজব' বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, “এসব গুজব, ভিত্তিহীন। যারা এগুলো ছড়াচ্ছে তাদের থামতে আহবান জানাচ্ছি।”

সোমবার (২৯ জুলাই) দুপুর পৌনে ২টার দিকে ডিবি কার্যালয়ের প্রধান ফটকে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগকে আস্থার জায়গা বলে উল্লেখ করেন অতিরিক্ত কমিশনার হারুন।

তিনি বলেন, “এখানে কাউকে বিনা কারণে আটক করা হয় না, চাপের মুখে জবানবন্দী আদায় করা হয় না। শিক্ষার্থীরা লিখিতভাবে স্বীকার করেছে যে সরকার তাদের সব দাবি মেনে নিয়েছে। এ কারণে আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রতি তার সহানুভূতি রয়েছে বলে জানান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন। বলেন, “আমরা নিরাপত্তার স্বার্থে এই ছয় সমন্বয়ককে এনেছি। এ নিয়ে নানা গুজব ছড়ালেও আমরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। তাদের ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তাহীনতার কারণে আমরা এই ব্যবস্থা নিয়েছি।”

হারুন বলেন, “গত রাত (রবিবার দিবাগত রাত) থেকে আমরা গুজব দেখতে পাচ্ছি যে তারা স্বেচ্ছায় এই বিবৃতি দেয়নি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ডিবি অফিস একটি আস্থার জায়গা, যেখানে কারো সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা অন্যায়ভাবে আটক করা হয় না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে নিরাপত্তার কারণে যারা আমাদের কাছে আসে বা যাদের নিয়ে আসি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।”

সমন্বয়করা ডিবি হেফাজতে কতদিন থাকবে জানতে চাইলে হারুন বলেন, “আমরা তাদের ও তাদের পরিবারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। শিগগিরই তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে।”

রবিবার কর্মসূচী প্রত্যাহার করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়কের বিবৃতি পাঠ করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তার পাশে আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুমকে বসে থাকতে দেখা যায়।

নাহিদ ইসলাম বলেন, "কোটা সংস্কার আন্দোলন ও তার প্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকে অপ্রত্যাশিতভাবে আহত এবং নিহত হয়েছেন। তাছাড়া, রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় অগ্নিসংযোগসহ নানা সহিংস ঘটনা ঘটেছে। আমরা এই সকল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত বিচারের দাবী জানাই। আমাদের প্রধান দাবী ছিল কোটার যৌক্তিক সংস্কার যা ইতোমধ্যে সরকার পূরণ করেছেন, এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর আহ্বান জানাই। সার্বিক স্বার্থে আমরা এই মুহুর্ত থেকে আমাদের কর্মসূচী প্রত্যাহার করছি।"

অন্য সমন্বয়কদের দাবি

অন্যদিকে, রবিবার (২৯ জুলাই) বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্য সমন্বয়করা, হেফাজতে থাকা পাঁচ সমন্বয়ককে দিয়ে জোর করে বিবৃতি দেওয়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন।

সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ তার বিবৃতিতে বলেছেন, "ডিবি কার্যালয়ে সমন্বয়কদের জিম্মি করে ব্ল্যাকমেইল করে এই লিখিত বক্তব্য পাঠ করানো হয়েছে।অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বিবৃতি আদায় ছাত্রসমাজ মেনে নিবে না।"

সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বলেছেন, "জিম্মি করে অস্ত্রের মুখে ডিবি অফিসে হাতে স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে জোরপূর্বক যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে তা এদেশের ছাত্রসমাজ প্রত্যাখ্যান করেছে..।"

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের তার বিবৃতিতে বলেছেন, "সমন্বয়কদের জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে যে স্টেটমেন্ট দেওয়ানো হইছে, সেটা কখনোই জাতির নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আটককৃত সমন্বয়করা ভয়ভীতির মুখে গোয়েন্দা সংস্থার লিখে দেওয়া যে বক্তব্য কেবল রিডিং পড়ে গেছে, আমরা সেই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি এবং একইসাথে জোরপূর্বক বক্তব্য আদায় করার মতো সরকারের এমন জঘন্য কাজের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি।"

৬ সমন্বয়কের মুক্তির নির্দেশনা চেয়ে রিট

বাংলাদেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন কর্মীদের ওপর গুলি না করার এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজত থেকে ছয় সমন্বয়কারীকে মুক্তির নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে।

সোমবার (২৯ জুলাই) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর আল মতিন প্রীতম ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা লিপি জনস্বার্থে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চে এই রিট দায়ের করেন।

এই বেঞ্চের রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আনিচ উল মাওয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, রিটে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, সেনাবাহিনী প্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।

সোমবার (২৯ জুলাই) রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে, হাইকোর্ট পরবর্তী শুনানি ও পরে এ বিষয়ে আদেশ দেয়ার জন্য মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) দিন ধার্য করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: ‘পুলিশ ঝুঁকিমুক্ত মনে করলে সমন্বয়কদের ছেড়ে দেয়া হবে’

কোটা সংস্কার আন্দোলনের পাঁচ সমন্বয়ককে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, পুলিশ তাদের ঝুঁকিমুক্ত মনে করলে ছেড়ে দেয়া হবে। রবিবার (২৮ জুলাই) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।

এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা নিজেরাই বলছেন তারা ঝুঁকিতে আছেন। একজন তার বাবাকে বলেছিলেন, তিনি বিশেষ প্রয়োজনে আত্মগোপন করেছেন। তারা নিজেরাই বলছেন, ঝুঁকিতে রয়েছেন। সেজন্য, তাদের নিরাপত্তার জন্য হেফাজতে নেয়া হয়েছে; আরো বলেন তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান (ফাইল ছবি)

আসাদুজ্জামান খান জানান “তাদের জিজ্ঞেস করা হয়, কোন কোন রাজনৈতিক দল কিংবা কারা তাদের প্ররোচনা দিয়েছে, যে কারণে পরবর্তীতে আন্দোলন সহিংস রূপ নিলো; এগুলো আমরা তাদের জিজ্ঞেস করছি। এগুলোর উত্তরও তারা দিচ্ছেন।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে এখনো তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি; হেফাজতে আছে। “তারা ঝুঁকি মুক্ত হলেই, ছেড়ে দিতে পারবো কি না, হিসাব-নিকাশ করছি। পুলিশ যদি মনে করে তারা ঝুঁকিমুক্ত, তাহলে তখনই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। আমরা তাদের গ্রেপ্তার করিনি;” যোগ করেন তিনি।

গত শুক্রবার বিকেলে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে পুলিশ হেফাজতে নেয়। পরে শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাহকে গোয়েন্দা পুলিশ তাদের হেফাজতে নিয়েছে।