যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রবিবার ২০২৪ সালে হোয়াইট হাউসের জন্য প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হবার প্রচেষ্টার সমাপ্তি ঘটিয়েছেন। বাইডেনের সিদ্ধান্ত আসে নির্বাচনের মাত্র চার মাস আগে ডনাল্ড ট্রাম্পের সাথে তাঁর বিপর্যস্ত টেলিভিশন বিতর্ক প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করার পর।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য বাইডেনের উপর ডেমোক্র্যাট দলের মিত্রদের ক্রমাগত চাপ ২৭ জুনের বিতর্ক অনুষ্ঠানের পর থেকে বৃদ্ধি পাবার পর এই সিদ্ধান্ত আসে। বিতর্ক অনুষ্ঠানে ৮১-বছর বয়স্ক প্রেসিডেন্ট তাঁর চিন্তা ধারার খেই হারিয়ে ফেলছিলেন, প্রায়ই প্রশ্নের উদ্ভট উত্তর দিচ্ছিলেন এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নানা মিথ্যাচারের জবাব দিতে ব্যর্থ হন।
বাইডেন তাঁর মেয়াদের বাকি সময় দায়িত্ব পালন করার পরিকল্পনা করছেন। তাঁর মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি, ওয়াশিংটন ডিসি সময় বেলা ১২টায়।
“আপনাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সম্মানের বিষয়। এবং যদিও পুনরায় নির্বাচিত হওয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল, আমি বিশ্বাস করি আমার দল এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমার সরে দাঁড়ানো উচিত, এবং আমার মেয়াদের বাকি সময় পুরোপুরি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনের দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত," বাইডেন সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ তাঁর নিজস্ব অ্যাকাউন্টে লেখেন।
তার ৩০ মিনিট পর, বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের প্রতি তাঁর সমর্থন ঘোষণা করেন। অগাস্ট মাসে শিকাগোতে ডেমোক্র্যাট দলের ন্যাশনাল কনভেনশনে আনুষ্ঠানিক মনোনয়নের জন্য হ্যারিস এখন তাৎক্ষনিক ফেভারিট।
“আজ আমি কমলাকে আমাদের দলের প্রার্থী হিসেবে আমার পূর্ণ সমর্থন এবং অনুমোদন দিতে চাই,” বাইডেন সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন। “ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা – এখন সময় হয়েছে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ট্রাম্পকে হারানোর।”
বাইডেন গত সপ্তাহে কোভিডে আক্রান্ত হবার পর ডেলাওয়ার সৈকতে তাঁর বাসায় অবস্থান নেয়ার সময় এই সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর পরিবার এবং বিশ্বস্ত সহকর্মীদের ছোট গ্রুপের সাথে আলোচনা করেছেন। বাইডেন বলেছেন তিনি এই সপ্তাহের পরের দিকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন, যেখানে তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্তারিত বলবেন।
বাইডেনের চিঠির সত্যতা হোয়াইট হাউস নিশ্চিত করেছে।
দু’দলই আসন্ন নির্বাচনকে কয়েক দশকের মধ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিণতিশীল নির্বাচন হিসেবে গণ্য করছে, এবং এই ঘোষণা তাদের উভয়ের জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা হিসেবে এসেছে। বিশেষ করে যখন এই সিদ্ধান্ত পেনসিলভানিয়ায় এক নির্বাচনী সমাবেশ ট্রাম্পকে হত্যা প্রচেষ্টার কয়েক দিন পরেই আসলো।
ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া
অতীতে কোন দলের অনানুষ্ঠানিক প্রার্থী নির্বাচনের এত কাছে এসে নিজেকে প্রত্যাহার করেন নি। সবচেয়ে কাছের উদাহরণ হবে প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন, যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের চাপে ১৯৬৮ সালের মার্চ মাসে ঘোষণা দেন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হবার জন্য প্রার্থী হবেন না।
বাইডেনের ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর সামাজিক মাধ্যমে ট্রুথ সোশালে এক পোস্টের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানান। ট্রাম্প বলেন যে বাইডেন কখনোই প্রেসিডেন্ট হবার যোগ্য ছিলেন না।
“ক্রুকেড জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবার যোগ্য ছিলেন না, এবং অবশ্যই দায়িত্ব পালনের জন্য যোগ্য ছিলেন না – কখনোই ছিলেন না! তিনি প্রেসিডেন্ট পদটি পেয়েছিলেন মিথ্যা আর ভুয়া খবরের মাধ্যমে এবং তাঁর বাসার অন্দরমহল থেকে বের না হয়ে,” ট্রাম্প বলেন।
“তাঁর ডাক্তার, মিডিয়াসহ আশে-পাশের সবাই জানতেন তিনি প্রেসিডেন্ট হবার যোগ্য ছিলেন না – এবং এখন, দেখ তিনি আমাদের দেশের কী হাল করেছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে, কোন রকম যাচাই-বাছাই ছাড়া, তাদের অনেকে কারাগার থেকে আসছে, মানসিক প্রতিষ্ঠান থেকে আসছে, এবং তাদের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যায় সন্ত্রাসী রয়েছে। তাঁর প্রেসিডেন্সির জন্য আমদের অনেক কষ্ট হবে, কিন্তু আমরা তাঁর করা ক্ষয়-ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে উঠবো।”
ডেমোক্র্যাটদের মনোনয়ন প্রক্রিয়া
এখন, ডেমোক্র্যাটদের জরুরী ভিত্তিতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাদের মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে সংহত করতে হবে এবং অল্প সময়ের মধ্যে ভোটারদের বিশ্বাস করাতে হবে যে, তাদের মনোনীত প্রার্থীর দায়িত্ব পালনের সামর্থ্য আছে এবং তিনি ট্রাম্পকে হারাতে পারবেন। আর ট্রাম্প বছরের পর বছর বাইডেনকে নিশানা করে রাখার পর এখন তাঁর মনোযোগ নতুন প্রার্থীর উপর ফেলতে হবে।
বাইডেনের সিদ্ধান্ত নির্বাচনী রাজনীতিতে তাঁর ৫২ বছরের ক্যারিয়ারে হঠাৎ এবং বিস্ময়কর এক ইতি টানছে। আরও চার বছর দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তিনি ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে দাতা, আইনজীবী, এমনকি নিজস্ব সহকারীরা তাঁর কাছে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
ডেমোক্র্যাট দলের প্রাইমারিতে বাইডেন একটি রাজ্য ছাড়া সবগুলোতেই মনোনয়নের ভোটে জয়ী হন এবং দলের কনভেনশনের জন্য ডেলিগেটদের সংখ্যাগরিষ্ঠ তাঁর পক্ষে নথিভুক্ত হন। এর ফলে দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তাঁর মনোনয়ন ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কিন্তু এখন যেহেতু তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন, এই ডেলিগেটরা কনভেনশনে অন্য প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে।
হ্যারিসকে স্বাভাবিক উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তার একটা কারণ হচ্ছে, নির্বাচনী প্রচারণা সংক্রান্ত ফেডেরাল নিয়ম অনুযায়ী, ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিস একমাত্র প্রার্থী যিনি বাইডেনের প্রচারণার জন্য সংগ্রহ করা বিশাল অর্থ ভাণ্ডারে হাত দিতে পারবেন।
বাইডেনের সমর্থন হ্যারিসের জন্য রাস্তা সহজ করতে সহায়তা করবে, কিন্তু তার মানে এই না যে সব কিছু নির্বিঘ্নে হবে।
ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশন শিকাগো শহরে ১৯-২২ অগাস্টে হওয়ার কথা। কিন্তু দল থেকে আগে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল যে, ডেলিগেটদের সশরীর উপস্থিতিতে কনভেনশনের কার্যক্রম শুরু হবার আগেই তারা অনলাইনে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনীত করা হবে।
এখন এটা দেখার বিষয় যে, অন্য কোন প্রার্থী মনোনয়নের জন্য হ্যারিসকে চ্যালেঞ্জ করবে কি না, বা কনভেনশনের সময় হ্যারিসের মনোনয়ন সহজ করার জন্য দল তাদের নিয়ম আবার বদল করবে কি না।
সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট
বাইডেন ২০২০ সালের নির্বাচনের সময় নিজেকে ‘পরিবর্তনকালীন’ প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল নতুন, তরুণ নেতৃত্বের জন্য সেতু হিসেবে কাজ করা। কিন্তু তিনি যখনই তাঁর বহুল-অপেক্ষিত দায়িত্ব, যার জন্য তিনি দশকের পর দশক কাজ করেছেন, সেটা পেয়ে গেলেন, তখন তিনি সেটা ছেড়ে দিতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না।
বাইডেনকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, অন্য কোন ডেমোক্র্যাট ট্রাম্পকে হারাতে পারবে কি না।
“সম্ভবত তাদের ৫০ জন পারবে,” বাইডেন উত্তর দেন। “না, আমিই একমাত্র ব্যক্তি না যে তাকে হারাতে পারবে, কিন্ত আমি তাকে হারাবো।”
বাইডেন ইতোমধ্যেই দেশের সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট এবং জোর দিয়ে বার বার বলেছেন তিনি নতুন প্রচারণা এবং আরেক মেয়াদের চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত। তিনি ভোটারদের বলেন, শুধু “আমাকে দেখো।”
এবং ভোটাররা বাইডেনকে দেখলো বটে। টেলিভিশন বিতর্কে তাঁর দুর্বল পারফরমেন্স ডেমোক্র্যাট সমর্থক এবং দাতাদের মধ্যে উৎকণ্ঠার বন্যা বইয়ে দেয়। তারা যে কথা আড়ালে বলতেন, সেটা প্রকাশ্যে বলা শুরু করলেন – তারা মনে করেন না যে আরও চার বছর দায়িত্ব পালন করার মত সামর্থ্য বাইডেনের আছে।
বাইডেন যেদিন পুনঃনির্বাচনের জন্য প্রার্থী হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করেন, তখন থেকেই তাঁর বয়স নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, যদিও ৭৮-বছর বয়সী ট্রাম্প মাত্র তিন বছর ছোট।
দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এনওআরসি সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ারস রিসার্চ ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে যে জরীপ করে, তার ফলাফল অনুযায়ী, বেশির ভাগ আমেরিকান মনে করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য বেশি বয়স্ক। সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরদাতা প্রেসিডেন্ট হবার জন্য বাইডেনের মানসিক শক্তি নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন, যদিও ট্রাম্পের জন্যও সেটা একটা দুর্বলতা।
বাইডেন প্রায়ই বলেন যে তিনি আগের মত তরুণ নয়, সহজে হাঁটতে পারেন না বা সাবলীলভাবে আগের মত কথা বলতে পারেন না। কিন্তু তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান আছে, যেগুলোর অনেক মূল্য রয়েছে।
“আমি একজন বাইডেন হিসেবে আমার কথা দিচ্ছি। আমি যদি মনে-প্রাণে বিশ্বাস না করতাম যে আমি এই দায়িত্ব পালন করতে পারবো, তাহলে আমি আর নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করতাম না,” তিনি নর্থ ক্যারলাইনায় টেলিভিশন বিতর্কের পরের দিন বলেন। “কারণ, সত্যি কথা বলতে, এখানে অনেক কিছু ভর করে আছে।”