কোটা বিতর্কঃ শেখ হাসিনার জন্য ছাত্রদের আন্দোলন এক দশকে সবচেয়ে বড় হুমকি

ঢাকার রামপুরা এলাকায় কোটা-বিরোধী বিক্ষোভকারীরা পুলিশ লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুঁড়ছে। ফটোঃ ১৮ জুলাই, ২০২৪।

জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মত ক্ষমতায় আসার মাত্র ছয় মাসের মাথায় শেখ হাসিনার সরকার গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক গণ অসন্তোষের মুখে পড়েছে।

নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছিল বিরোধী দলের বর্জনের কারণে, কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকার যে চালেঞ্জের মুখোমুখি, তা আসছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের কাছ থেকে, যারা দৃশ্যত কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নয়।

‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে শিক্ষার্থীরা জুলাই মাসের শুরু থেকে বিক্ষোভ করে আসছে। তাদের দাবী প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা।

বর্তমানে সরকারী চাকুরির ৫৬ শতাংশ বিভিন্ন বিশেষ ক্যাটেগরির – মুক্তিযোদ্ধা, নারী, জেলা, সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধি – প্রার্থীর জন্য সংরক্ষিত। বাকি ৪৪ শতাংশ থাকে সাধারণ প্রার্থীদের জন্য। এই ব্যবস্থা, আন্দোলনকারী ছাত্ররা বলছে, যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীর বিরুদ্ধে বৈষম্য করে।

ঢাকায় কোটা-বিরোধী বিক্ষোভকারীরা পুলিশের টিয়ার গ্যাসের মধ্যে দৌড়াচ্ছে। ফটোঃ ১৭ জুলাই, ২০২৪।

প্রতিবাদ বিক্ষোভ বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) মারাত্মক রূপ নেয়, যখন আন্দোলনকারীরা সারা দেশে হরতালের ডাক দেয় এবং পুলিশের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষে অন্তত ২৫জন নিহত হয়।

এর দুদিন আগে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ছয়জনের মৃত্যু হয়, যার জন্য স্থানীয় গণমাধ্যম আর পর্যবেক্ষকরা মূলত পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগকে দায়ী করে।

শুক্রবার সহিংসতায় অন্তত আরও ৩৫জন নিহত হয় বলে জানা গেছে। জারী করা হয়েছে সান্ধ্য আইন, প্রস্তুত রাখা হয়েছে সামরিক বাহিনী।

রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে সরকার

কোন রাজনৈতিক বিতর্কে এই মাত্রায় সহিংসতা আর প্রাণহানি বাংলাদেশে সম্ভবত ২০১৩-১৪ সালে জামাতে ইসলামের সহিংস বিক্ষোভের পর আর দেখা যায় নি। এক দিকে কোটা-বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্র লীগ আর পুলিশের সশস্ত্র হামলা, অন্য দিকে বিটিভি ভবন, বিআরটিএ ভবন, টোল প্লাজা ইত্যাদি সহ সরকারী এবং বেসরকারী সম্পত্তিতে সন্দেহভাজন আন্দোলনকারীদের আগুন এবং ভাংচুর।

এই উত্তপ্ত আন্দোলন এসেছে সরকারের জন্য এক নাজুক সময়ে,যখন দেশের অর্থনীতি নানা কারণে চাপের মুখে এবং দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং প্রাক্তন ছাত্র নেতা মুশতাক হোসেন।

ফাইল ফটোঃ প্রধামমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে জয়লাভের পরের দিন গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন।

জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে জনমনে ক্ষোভ এখনো বিদ্যমান, সরকারের উচ্চ মহলে ব্যাপক দুর্নীতি সাম্প্রতিক সময়ে ফাঁস হওয়া এবং পেনসন স্কিম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চলমান ধর্মঘট – সব একত্রিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য পরিস্থিতি একটা ব্যাপক ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে।

“ছাত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিভিন্ন গ্রুপ এটার সাথে জড়িত হবার ফলে কোটা-বিরোধী আন্দোলন এই সরকারের জন্য তাদের সবচেয়ে গুরুতর এবং ব্যাপক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে,” হোসেন ভিওএ-কে বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন বা ডাকসুর প্রাক্তন জিএস মুশতাক হোসেন বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সরকার কোটা-বিরোধী ছাত্রদের তাদের ‘শত্রু’ হিসেবে বিবেচনা করছে এবং তাদের আন্দোলনকে রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে গণ্য করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সরকার অন্য কিছু আন্দোলন – যেমন, নিরাপদ সরক, প্রথম কোটা বিরোধী বিক্ষোভ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন – যেভাবে পুলিশ আর ছাত্র লীগের সহিংসতা দিয়ে দমন করেছে, হোসেন মনে করেন এই আন্দোলনও সরকার সেভাবেই দমন করতে চেয়েছে।

ঢাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষের সময় কোটা-বিরোধী বিক্ষোভকারীরা দডেউ টিনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ফটোঃ ১৯ জুলাই, ২০২৪।

কিন্তু হিতে বিপরীত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। আন্দোলন বিস্তার লাভ করেছে, ক্যাম্পাসের বাইরে তাদের সমর্থন ছড়িয়ে পড়েছে।

“সরকার তো ইতোমধ্যেই বিক্ষোভকারীদের উপর সহিংসতা চালিয়েছে, এখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের আগের রূপ নিয়ে মাঠে নামে, তাহলে পরিস্থিতি সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে,” তিনি বলেন।

কোটা নিয়ে সমস্যা কোথায়?

স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারী চাকুরির ৩০ শতাংশ এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য ১০ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু নারীদের কোটা নিয়মিত পুড়ন না হওয়ায় ১৯৮৫ সালে সাধারণ নারীদের ১০ শতাংশ কোটার আওতায় নিয়ে আসা হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা অপরিবর্তিত রেখে ১৯৯৭ তাদের সন্তানদের এবং ২০১০ সালে তাদের নাতী নাতনীদের জন্য ৩০ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়।

সরকারী চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন হয় ২০১৮ সালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনার দাবীর পক্ষে সেই আন্দোলন সাধারণ ছাত্রদের মাঝে ব্যাপক সমর্থন পায়।

ঢাকায় আন্দোলনকারীরা পুলিশের একজন সদস্যকে ঘিরে বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটাচ্ছে। ফটোঃ ১৮ জুলাই, ২০২৪।

সরকার প্রথমে দাবী বিবেচনা করতে নারাজ হলেও, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সবাইকে হতবাক করে দিয়ে পুরো কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে দেন – এমনকী নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধিদের কোটাও। এরকম সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ হলেও, সরকার অনড় থাকে এবং ছাত্রদের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে।

কিন্তু বিপদ আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে এ’বছরের জুন মাসে, যখন কিছু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য সহ কয়েকজন হাই কোর্টে ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে। হাই কোর্ট তার রায়ে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে বেআইনি ঘোষণা করে সরকারী চাকুরিতে সকল কোটা পুনর্বহাল করে।

আন্দোলনের মাত্রা তীব্র

হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করেছে এবং ছাত্র প্রতিনিধিও সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে। বিষয়টা এখন সর্বোচ্চ আদালতের সামনে এবং বিচারপতিরা ছাত্রদের ন্যায় বিচারের আশ্বাস দিয়ে ক্লাসে ফিরে যেতে বলেছে।

কিন্তু আন্দোলন থেমে যায় নি, বরং তার মাত্রা আরও তীব্র হয়েছে। আন্দোলনকারীরা বিষয়টি আদালতে সম্পন্ন করতে নারাজ – তাদের দাবী নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কোটা বাতিল। ছাত্রদের অনেকে সন্দিহান, আদালতে যাওয়া মানেই হবে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করা।

“আমরা কোটা চাই না, কোন প্রকার কোটাই চাই না,” ভিওএ-কে বলেন ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর এক সমন্বয়ক মহিউদ্দিন রনি। “সংখ্যালঘু আর পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের উচিত আমাদের সাথে যোগ দেয়া এবং আমরা আলোচনা করবো কীভাবে কোটা কমানো যায়।”

ঢাকায় কোটা-বিরোধী আন্দোলনকারীরা সেতু ভবনে আগুন দেয়। ফটোঃ ১৯ জুলাই, ২০২৪।

সরকারী চাকুরিতে কোটা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয় – ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই চাকুরীতে কোটা ব্যবস্থা ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন অঞ্চল, নারী, জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ সমাজ এখন বলিষ্ঠভাবে এই ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, কারণ তারা মনে করছে এই ব্যবস্থা তাদেরকে উপযুক্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে।

“এই তরুণ প্রজন্ম কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধির শিকার ... অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে না,” অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ ঢাকার দ্য ডেইলি স্টার পত্রিয়ায় লিখেছেন। “চাকুরী পাবার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ... ছাত্রদের মাঝে হতাশা এবং ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।”

সমাধানের সুযোগ হাতছাড়া

প্রথম কোটা-বিরোধী আন্দোলনের ছয় বছর পর বোঝা যাচ্ছে, ছাত্রদের সেই ক্ষোভ আগে যেরকম ছিল, এখন আরও তীব্র হয়েছে। গত দু’সপ্তাহে হাজার হাজার ছাত্র রাস্তায় বেরিয়ে গেছে, বিভিন্ন স্থানে অবরোধ সৃষ্টি করেছে, শহরের ভেতরে এবং মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করেছে, পুলিশ আর ছাত্র লীগের সাথে বিভিন্ন স্থানে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে।

ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ টিয়ার গ্যাস শেল নিক্ষেপ করছে। ফটোঃ ১৮ জুলাই, ২০২৪।

সহিংসতা থামাতে কর্তৃপক্ষ চিরাচরিত নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্রদের হল ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেয়। পরিস্থিতির অবনতি দেখে প্রধানমন্ত্রী বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।

হাসিনা সহিংসতার ব্যাপকতা স্বীকার করেন এবং সকল হত্যাকাণ্ডের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দেন। কিন্তু তিনি আন্দোলনের মূল বিষয়টা নিয়ে কোন অঙ্গীকার করা থেকে বিরত থাকলেন।

“এ’বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট তার রায় না দেয়া পর্যন্ত সবাইকে আমি ধৈর্যশীল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমি নিশ্চিত ছাত্র সম্প্রদায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে ন্যায় বিচার পাবে, তারা হতাশ হবে না,” হাসিনা বলেন। অর্থাৎ, তিনি কোটা বিতর্ক আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির উপরই আবার জোর দিলেন।

মুস্তাক হোসেন মনে করছেন হাসিনা তাঁর সুর অনেকটা নরম করেছেন, কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে তিনি কোটা ব্যবস্থা সংস্কার, যেটা ছাত্রদের মূল দাবী, তা নিয়ে কোন পদক্ষেপ ঘোষণা করেন নাই। হোসেন মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী এখানে একটি সুযোগ হাতছাড়া করেছেন।

“এই সরকার খুবই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, এটা একটি রাজনৈতিক সরকার এবং তারা জানে কীভাবে পরিস্থিতি সামলাতে হয়। তারা যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয় এবং সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পরে, তাহলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, দেশের গণতন্ত্র, সবই হুমকির মুখে পরবে,” তিনি বলেন।