দক্ষিণ এশিয়ায় উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিকদের হত্যা: একটি পর্যবেক্ষণ

ফাইল: নতুন দিল্লিতে রাজনৈতিক বিক্ষোভের সময়ে পুলিশের ব্যারিকেড এবং একিট সরকারি ভবনে মহাত্মা গান্ধীর ছবি। ভারত, মার্চ ২২,২০২৪।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী ঘটনা কিন্তু তা বিশ্বজুড়ে এই অভিন্ন প্রবণতাকেই তুলে ধরছে।

রাজনৈতিক হত্যকান্ড দীর্ঘদিন ধরেই মানব ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে রয়েছে। ওয়েস্ট পয়েন্ট’এ কম্ব্যাটিং টেররিজম সেন্টারের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে প্রায়শই এ রকম ঘটনা ঘটে সেই সব দেশে যেখানে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা খুব সীমিত এবং বড় রকমের মেরুকরণ ও বিভাজন রয়েছে।

এই সেন্টার তাদের ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলেছে বিশেষত নির্বাচন ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সময়ে এই সব পরিস্থিতি রাজনৈতিক বৈধতাকে খর্ব করতে এবং সহিংসতা বৃদ্ধি করতে পারে।

আধুনিক দক্ষিণ এশিয়া রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বড় রকমের ক্ষেত্র হয়ে রয়েছে। ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীকে একজন জঙ্গি হিন্দু জাতীয়তাবাদি হত্যা করে। মুসলিমদের প্রতি গান্ধীর সহানুভূতি নিয়ে এই ঘাতক তাঁর উপর ক্ষুব্ধ ছিল।

গান্ধীকে হত্যার ঘটনা নবীন রাষ্ট্রটিকে আহত করেছিল কিন্তু, যেমনটি ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ লিখছেন, সেই সাথে জাতীয় ঐক্যের আহ্বানও শোনা গিয়েছিল। জওহর লাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেলের মত নেতারা তাঁদের মতভেদকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন।

যে ধরণের রাজনৈতিক সহিংসতা গান্ধীর জীবন কেড়ে নিয়েছিল, সে রকম ঘটনা যে এক ভাবে ভারতেই ঘটেছিল তা নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দু’টি রাষ্ট্র ভূটান ও মালদ্বীপ ছাড়া বাকি সব দেশই তাদের নেতাদের হারিয়েছে হয় ঘাতকদের গুলির আঘাতে নয়ত আত্মঘাতী বোমার আঘাতে। যদিও প্রায়ই রাষ্ট্রপ্রধানরাই এ রকম হত্যাকান্ডের শিকার হন, বহু রাজনৈতিক নেতা মূখ্যমন্ত্রীদের থেকে শুরু করে সংসদ সদস্যরাও ঘাতকদের শিকারে পরিণত হয়েছেন।

দ্য কম্ব্যাটিং টেররিজম সেন্টারের গবেষণায় দেখা গেছে যে সাম্প্রতিক দশকগুলিতে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক হত্যকান্ডগুলি প্রায়শই ঘটে থাকছে । ১৯৮০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে ৭৬% রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ায়।

এখানে আমরা তুলে ধরছি এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা এবং তার পরিণতি:

আফগানিস্তান

  • মোহাম্মাদ দাউদ খান( এপ্রিল ২৭, ১৯৭৮): আফগানিস্তানের বামপন্থি পিপলস ডেমক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্বে সংঘটিত অভূত্থানে তিনি সপরিবারে নিহত হন। ফলাফল : কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয় এবং সোভিয়েট প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

  • নুর মোহাম্মদ তারাকি( অক্টোবর ৯,১৯৭৯): প্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিনের আদেশে তাঁকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। ফলাফল: রাজনৈতিক দমন-নিপীড়ন বৃদ্ধি পায় এবং সোভিয়েট দখলের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

  • হাফিজুল্লাহ আমিন( ডিসেম্বর ২৭,১৯৭৯): তেজবাগ প্রাসাদে সোভিয়েট বিশেষ বাহিনীর অভিযানে নিহত। ফলাফল: সোভিয়েট দখলের শুরু এবং কয়েক দশক ধরে যুদ্ধের সূচনা।

  • মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ( সেপ্টেম্বর ২৭,১৯৯৬): কাবুল দখলের পর তালিবান ক্ষমতাচ্যূত কমিউনিস্ট নেতাকে নির্যাতন করে হত্যা করে। ফলাফল: তালিবানের প্রথম পর্বে ক্ষমতা লাভের সূচনা।

  • বুরহানুদ্দিন রাব্বানি( সেপ্টেম্বর ২০,২০১১): তালিবানের শান্তি দূত পরিচয়দানকারি একজন আত্মঘাতী বোমাবাজের হামলায় কাবুলে নিহত। ফলাফল : শান্তি আলোচনায় ব্যাঘাত এবং ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার প্রকাশ।

বাংলাদেশ:

  • শেখ মুজিবুর রহমান( আগস্ট ১৫,১৯৭৫): বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে সম্মানিত শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা রক্তাক্ত অভূত্থানে হত্যা করে। ফলাফল: সামরিক শাসন জারি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সূচনা

  • জিয়াউর রহমান( মে ৩০,১৯৮১): এই সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্টকে তাঁর ছয় জন দেহরক্ষী ও দু জন সহযোগীসহ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগামে এক সামরিক অভূত্থানে হত্যা করা হয়। ফলাফল: আরও গোলযোগ এবং সামরিক শাসনের উত্থান।

ভারত:

  • মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী( জানুয়ারি ৩০,১৯৪৮): দিল্লিতে তাঁর প্রাত্যহিক প্রার্থনা স্থলে তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘাতক যে একজন ডানপন্থি রাজনৈতিক কর্মী ছিল পরে দাবি করে যে গান্ধীর “মুসলমানদের তোয়াজ করার” বিষয়টি তাকে এ কাজ করতে উস্কানি দেয়। ফলাফল: গান্ধীর প্রধান অনুসারিরা নিজেদের মধ্যকার দ্বিমতের অবসান ঘটিয়ে ভারতকে একতাবদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ হন।

  • ইন্দিরা গান্ধী ( অক্টোবর ৩১,১৯৮৪): তাঁর সরকারি বাসভবনে তাঁর দু জন শিখ দেহরক্ষী তাঁকে গুলি করে হত্যা করে । বাহ্যত এই হত্যাকান্ডটি ছিল বিখ্যাত শিখ মন্দিরে সামরিক অভিযানের প্রতিশোধ গ্রহণ। ফলাফল: শিখ-বিরোধী দাঙ্গা শুরু এবং উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক উত্থান।

  • রাজীব গান্ধী ( মে ২১,১৯৯১): লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল এলাম(এলটিটিই)’র এক সদস্যের আত্মঘাতী বোমায় নিহত হন। দলটি বর্তমানে নিষিদ্ধ শ্রীলংকার বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী। ফলাফল: এলটিটিই’র বিরুদ্ধে অভিযান এবং শ্রীলংকার প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন।

নেপাল

  • রাজা বীরেন্দ্র ( জুন ১, ২০০১): পরিবারের আট সদস্যসহ যুবরাজ দীপেন্দ্রের গুলিতে নিহত। কাঠমন্ডুর রাজ প্রাসাদে পারিবারিক সমাবেশে যুবরাজ গুলি চালান। ফলাফল: রাজতন্ত্রের অবসান এবং তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তন।

পাকিস্তান

  • লিয়াকত আলী খান( অক্টোবর ১৬,১৯৫১): পাকিস্তানের এই প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক রাজনৈতিক সমাবেশে গুলি করা হয় এবং পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান। হত্যাকারীকে পুলিশ হত্যা করে কিন্তু ঘটনাটির কোন নিস্পত্তি হয়নি। ফলাফল : তাঁর মৃত্যু পাকিস্তানকে গণতন্ত্র থেকে সরিয়ে আনে এবং সাত বছরের মধ্যে একজন সামরিক নেতা ক্ষমতা দখল করেন।

  • বেনজির ভূট্টো (ডিসেম্বর ২৭,২০০৭): এক রাজনৈতিক সমাবেশে আত্মঘাতী বোমা হামলায় এবং গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়। ফলাফল: উপর্যুপরি সহিংসতা ও প্রতিবাদের পর, পরের বছর ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে।

  • ইমরান খান (নভেম্বর ৩,২০২২): সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী একটি বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময়ে তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টায় বেঁচে যান। ফলাফল: তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণ ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি হুমকিকে তুলে ধরে।

  • শ্রীলংকা

  • সলোমন বন্দরনায়েক: ( সেপ্টেম্বর ২৬,১৯৫৯): শ্রীলংকার চতুর্থ এই প্রধান মন্ত্রীকে তাঁর বাসভবনে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু গুলি করে হত্যা করে। ফলাফল: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সূচনা এবং সরকারে পরিবর্তন।

  • রণসিংহে প্রেমদাসা ( মে ১, ১৯৯৩): শ্রীলংকার এই তৃতীয় প্রেসিডেন্ট আরো ২৩ জন সহ, এলটিটিই’র বোমাবাজদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন। ফলাফল: শ্রীলংকার গৃহযুদ্বের ব্যাপকতা এবং লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল এলামের বিরুদ্ধে সরকারের জোরালো অভিযান।