কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের আরো কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েরে কর্তৃপক্ষ বুধবার (১৭ জুলাই) বিকেলের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
এর আগে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এক অফিস আদেশে জানায়, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দেশের সব পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত মেডিকেল, টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য কলেজসহ সব কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।”
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আবাসিক হল ত্যাগের নির্দেশনা দিয়ে নিরাপদ আবাসস্থলে অবস্থানের নির্দেশনা দিতে বলা হয় ইউজিসি এক অফিস আদেশে।
ইউজিসির এই অফিস আদেশের ভিত্তিতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায়, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বুধবার (১৭ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক মাহমুদ আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট কমিটির এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বুধবার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। হল খুললে, মেধার ভিত্তিতে আসন বরাদ্দ সাপেক্ষে শিক্ষার্থীদের হলগুলোতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া, সংঘর্ষে আহত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।এছাড়া, কোটা সমস্যা যৌক্তিকভাবে সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা
কোটা সংস্কার আন্দোলনের চলমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দেয়া নির্দেশনা মেনে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানায় প্রশাসন। বুধবার (১৭ জুলাই) দুপুর ১টার দিকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. অহিদুল আলম।
তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় জরুরি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মেয়েদের সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে এবং ছেলেদের রাত ১০টার মধ্যে হল ত্যাগ করতে হবে বলে জানান তিনি। এছাড়া, হল প্রভোস্টদের সবগুলো রুম সিলগালা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে; আরো জানান তিনি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হল বন্ধের নির্দেশ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার দুপুর ১২টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। এর প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের গেট তালাবদ্ধ করে সবাইকে হলত্যাগে বাধা দিচ্ছে আবাসিক শিক্ষার্থীরা।এছাড়া হলের প্রাধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করে রাজনীতিমুক্ত সোহরাওয়ার্দী হল প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে তারা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, “যে ছাত্র রাজনীতি আমাদের কোনো উপকারে আসে না উল্টো বিভিন্ন ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়, সেই ছাত্র রাজনীতি এই হল থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।” হল ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত জানান শিক্ষার্থীরা।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “যদিও আমি চাই ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হোক, কিন্তু সবকিছু আমার হাতে নেই। আবাসিক শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারবো।”
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা হলসহ বেশ কিছু ছাত্রী হলে তালা দিয়েছে আবাসিক শিক্ষার্থীরা। হলের ভিতরেই অবস্থান নিয়েছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য আবাসিক হলগুলোর শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগের নোটিশের প্রতিবাদে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আসাবুল হক জানান, “সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা আছে আবাসিক হলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্রে আমরা নিরাপত্তা দেয়ার জন্য হলগুলো তালাবদ্ধ করে রাখবো।”
হল বন্ধের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে পরবর্তী কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে হলত্যাগের নির্দেশ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) একমাত্র ছাত্রী হল বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীদের বুধবার বিকাল ৪টার মধ্যে হলত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম জানান, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম চলবে; তবে বন্ধ থাকবে সব শিক্ষা কার্যক্রম।
বুধবার (১৭ জুলাই) উপাচার্যের কনফারেন্স রুমে এক জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানান তিনি।
উপাচার্য আরো জানান, বুধবার বিকাল ৪টার মধ্যে ছাত্রীদের হলত্যাগ করতে হবে। “পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। তবে প্রশাসনিক কার্যক্রম চলবে;” তিনি যোগ করেন।
এদিকে হলত্যাগের নির্দেশ পাওয়ার পরপরই হলের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে ছাত্রীরা। 'প্রশাসনের সিদ্ধান্ত মানি না', 'হল কারো বাবার না', 'হল আমাদের বাড়ি, আমরা এখান থেকে যাব না' স্লোগান দিতে থাকে তারা।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ দীপিকা রানী সরকার বলেন, “এই মুহূর্তে কথা বলতে পারছি না। মেয়েরা হল থেকে যেতে হতে চায় না। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।”
যবিপ্রবি বন্ধ ঘোষণা
দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায়, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাজনিত কারণে পুনরায় আদেশ না দেয়া পর্যন্ত যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বুধবার সকালে যবিপ্রবির প্রশাসনিক ভবনের সম্মেলন কক্ষে নীতি-নির্ধারণী ফোরাম রিজেন্ট বোর্ডের ১০২তম জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সভায় বিকাল ৪টার মধ্যে ছাত্রদের এবং বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার মধ্যে ছাত্রীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়।
উপাচার্য ও রিজেন্ট বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও, দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
একইসঙ্গে ছেলেদের আবাসিক হল বিকেল ৪টার মধ্যে এবং মেয়েদের আবাসিক হল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার মধ্যে ত্যাগ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সব স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা
এর আগে, মঙ্গলবার (১৬ জুলাই), বাংলাদেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত দেশের সব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোও বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়ের স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদ্যালয় ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শ্রেণী কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিতে প্রবশে কোটা আইন সংস্কারের দাবিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বিক্ষোভ শুরু করে। আন্দোলনে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও অংশ নিতে দেখা যায়।