প্রবল বৃষ্টিপাত: জলাবদ্ধতায় অচল ঢাকা, সুনামগঞ্জে তৃতীয় দফা বন্যা

বাংলাদেশে বন্যা

টানা প্রবল বৃষ্টিপাতে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। শুক্রবার (১২ জুলাই) সকাল থেকে শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। এর ফলে, ঢাকার কয়েকটি প্রধান সড়ক, বিভিন্ন মোড়, গুরুপূর্ণ এলাকা এবং নিচু এলকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে যান চলাচল ব্যাহত হয়, ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী।

অন্যদিকে, অবিরাম বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে আবার বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এ নিয়ে তৃতীয় দফা বন্যা দেখা দিলো সুনামগঞ্জ জেলায়। এর আগে, ১৬ জুন ও ১ জুলাই বন্যার সম্মুখীন হয় এই জেলার মানুষ। এছাড়া, নতুন করে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায়, সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে।

ঢাকায় জলাবদ্ধতা

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় শুক্রবার (১২ জুলাই) সকাল থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হলে, এই মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টিপাত সপ্তাহান্তে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দেয়।

ভোর থেকে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টিপাত; চলে দুপুর পর্যন্ত। এই বর্ষণে, ঢাকারর কাকরাইল, মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর, ফার্মগেট, বাড্ডা, মগবাজার, মিরপুর ও খিলক্ষেত এলাকায় পানি জমে যায়। জল ভেঙ্গে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয় মানুষকে।

ইঞ্জিনে বৃষ্টির পানি ঢুকে সড়কে বিকল হয় অনেক ব্যক্তিগত গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাঁচাবাজারে আসা ক্রেতা-বিক্রেতা, ছুটির দিকে গ্রামের বাড়ি যাওয়া যাত্রীরা বেশ সমস্যায় পড়েন।

প্রাইভেটকার চালক শাহ আলম জানান, তিনি গুলশান যাওয়ার জন্য সকাল ৭টার দিকে মৌচাক থেকে বের হন। জলাবদ্ধতার কারণে মৌচাকের একটি গলিতে আটকা পড়েন ঘন্টাখানেক।

নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বেসরকারি চাকরিজীবীরা। তারা বলেন, হালকা বৃষ্টি হলেই নিচু এলাকাগুলো তলিয়ে যায়। ভারী বৃষ্টি হলে সমস্যার সীমা থাকেনা। তারা আরো বলেন, ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হচ্ছে ঢাকা।

বৃষ্টির কারণে সড়কে গণপরিবহনের উপস্থিতি ছিলো কম। এই যানবাহন সংকট পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিপাকে ফেলে। মালিবাগ, শান্তিনগর, মগবাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার কারণে যানবাহন সংকটকে তীব্রতর করে। জলাবদ্ধতার সুযোগে রিকশাচালকরা অতিরিক্ত টাকা দাবি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।

এদিকে, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ তারিফুল নেওয়াজ কবির জানিয়েছেন, সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা কয়েছে ঢাকায়। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এর প্রভাবে আরো বৃষ্টিপাত হতে পারে।

ডিএমপির সতর্কতা

শুক্রবার সকাল থেকে টানা ভারী বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট যানজটের বিষয়ে রাজধানীর কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ।

ডিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জলাবদ্ধতার কারণে অনেক যানবাহন বিকল হয়ে যাওয়ায় নগরীর সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। নগরবাসীকে সাবধানে চলাচল করতে অনুরোধ করেছে ডিএমপি।

যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে, সে গুলো হলো; ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, বায়তুল মোকাররম, শান্তিনগর, মালিবাগ, আরামবাগ, প্রগতি সরণি, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি রাপা প্লাজা, বংশাল, মিরপুর রোকেয়া সরণি, দয়াগঞ্জ ক্রসিং, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, নিমতলী, টয়েনবি সার্কেল রোড, ধানমন্ডি ২৭, এলিফ্যান্ট রোড, মৎস্য ভবন, কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি, ঢাকা গেট ভিআইপি রোড ও মিরপুর মাজার রোড।

ডিএনসিসির উদ্যোগ

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)। এই সমস্যা সধাধানে ৫ হাজারের বেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ১০টি কুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি) নিয়োগ করেছে ডিএনসিসি।

ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসেনের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দ্রুত পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত করতে, ১০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত ১০টি কিউআরটি ১০টি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় কাজ করছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, যান চলাচলের সুবিধার্থে দ্রুত পানি সরাতে কল্যাণপুরে পাঁচটি পাম্প সকাল থেকে একযোগে কাজ করছে। দুপুরের পর কয়েকটি সড়ক থেকে পানি সরানো সম্ভব হয়েছে বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

জলাবদ্ধতা দেখা দিলে ডিএনসিসির হটলাইন ১৬১০৬ নম্বরে ডায়াল করে জানাতে নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে। করপোরেশনের প্রকৌশল ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিভাগ সচল রয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

সুনামগঞ্জে আবার বন্যা

অবিরাম বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে আবার বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এ নিয়ে তৃতীয় দফায় বন্যার মুখোমুখি হলো সুনামগঞ্জবাসী।

গত ১৬ জুন সুনামগঞ্জে বন্যার কবলে পড়ে হাওরবাসী। পরবর্তীতে ১ জুলাই দ্বিতীয় দফার বন্যার সম্মুখীন হয় জেলার মানুষ। আবার অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়ছে জেলার সব নদ-নদীর পানি। তৃতীয় দফায় বন্যা সৃষ্টি হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়।

ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমা বিপদ সীমা অতিক্রম করেছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন জেলার লক্ষাধিক মানুষ। শুক্রবার (১২ জুলাই) সকাল ৬টায় সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢল নেমে আসতে শুরু করেছে; ধোপাজান, যাদুকাটা ও পাটলাই নদী এবং খাসিয়ামার, চেলা নদী দিয়ে। জেলার প্রধান নদী সুরমা বিপদ সীমা অতিক্রম করেছে। এছাড়া পানি বেড়েছে হাওরে। এতে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় আবার বন্যায় পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, সুনামগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতে বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢল অব্যাহত রয়েছে। এ করাণে, নামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বেড়ে বিপদ সীমা অতিক্রম করেছে। জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে বলে জানান তিনি।

বাড়ছে যমুনার পানি

উজানের ঢল ও বর্ষণে আবার যমুনার পানি বাড়তে শুরু করেছে। ফলে সিরাজগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বেড়েছে ১২ সেন্টিমিটার। এর ফলে যমুনা এখন বিপদ সীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিকাল থেকে রাতভর দফায় দফায় বৃষ্টি ও উজানের ঢলে যমুনার পানি আবার বাড়ছে। এতে নদীর তীরবর্তী চৌহালী, বেলকুচি, শাহজাদপুর, কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চল আবার বন্যার কবলে পড়েছে।

পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন বহু মানুষ। জলমগ্ন নিম্নাঞ্চলের অনেক পরিবার স্থানীয় ওয়াপদা বাঁধ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।

বন্যা কবলিত এলকার বাসিন্দারা জানান, নদীর তীরবর্তী চৌহালী, বেলকুচি, শাহজাদপুর, কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে বহু ঘরবাড়ি, গাছপালা ও জায়গাজমি নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। বিশেষ করে চৌহালী উপজেলার ভূতের মোড় থেকে ময়নাল সরকারের কবরস্থান পর্যন্ত তীব্র ভাঙনে কবলে পড়েছে।

এছাড়া, কাজিপুর উপজেলার খাসরাজবাড়ি, তেকানী, নিশ্চিন্তপুর, চরগিরিস, শাহজাদপুর উপজেলার হাটপাচিল, জালালপুর, কৈজুড়ী ও সদর উপজেলার চরাঞ্চলে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নাজমুল হাসান জানান, যমুনায় পানি আবার বাড়ছে। এতে নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভাঙন রোধে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।