বাংলাদেশে চলমান কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনের নামে স্বাধীনতাবিরোধীরা যড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে অভিযোগ করেছেন দেশটির আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের অভিযানের প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা শুক্রবার (১২ জুলাই) সারা দেশে ক্যাম্পাসে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে স্বাধীনতাবিরোধীরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। শুক্রবার (১২ জুলাই) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রেলস্টেশনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ মন্তব্য করেন তিনি।
“যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী ও বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিলো, কোটা আন্দোলনে সেই অপশক্তির ষড়যন্ত্র নেই, তা বলতে পারবো না;” যোগ করেন আনিসুল হক। তিনি আশা প্রকাশ করেনে যে কোটা আন্দোলন নিয়ে সর্ব্বোচ্চ আদালতের আদেশ মেনে শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যাবেন।
জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখা সরকারের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, যদি কেউ এ বিষয়ে বাধা সৃষ্টি করে, তবে সরকারকে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশব্যাপী সমাবেশ কর্মসূচি
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের অভিযানের প্রতিবাদে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা শুক্রবার (১২ জুলাই) সারা দেশে ক্যাম্পাসে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে শাহবাগ মোড়ে ৪ ঘণ্টা ধরে চলা অবরোধ শেষে, কোটা আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম এ কর্মসূচির কথা জানান।
এর আগে, বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিভুক্ত ৭ কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সমবেত হন।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে, হাজার হাজার শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ শেষে শাহবাগ মোড়ের সমাবেশে যোগ দেন। পুলিশ বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও, শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যান।
ওবায়দুল কাদের: ‘রাজনৈতিকভাবে জবাব দেবো’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আদালতের নির্দেশনা মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের কোটা বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিএনপির আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে দেবে না আওয়ামী লীগ। এই অরাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে কেউ রাজনীতি করার চেষ্টা করলে আমরা রাজনৈতিকভাবে তার জবাব দেবো।”
তিনি বলেন, “কোটা কোনো ধরনের বৈষম্য নয়; কিছু বৈষম্য দূর করার জন্য এগুলো প্রয়োজন।” কোটা ইস্যুতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করেছে বলে উল্লেখ করেন ওবায়দুল কাদের। বলেন, “আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, চলমান বিচারিক কার্যক্রম ও আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও তথাকথিত বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির অজুহাতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “বিএনপিসহ কয়েকটি দল প্রকাশ্যে কোটা আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল প্রকাশ্যে বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রয়োজন নেই।”
সবাইকে সর্বোচ্চ আদালত ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহবান জানান ওবায়দুল কাদের।
উসকানির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান বিএনপির
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে বিএনপি উসকানি দিচ্ছে, সরকারের এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বিএনপির এ ধরনের আন্দোলনে জড়ানোর কোনো কারণ নেই।
তিনি আরো বলেন, “আমাদের এ ধরনের আন্দোলনে ইন্ধন দেয়ার প্রশ্নই আসে না। এই সব আন্দোলন তাদের (শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের) নিজস্ব।”
সোমবার (৮ জুলাই) ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে এসব আন্দোলন পরিচালনা করছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা কেন এই আন্দোলনে উসকানি দেবো? আমাদের এটা করার কোনো কারণ নেই।”
তবে তিনি জানান, তাদের দল মনে করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের আন্দোলন এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যৌক্তিক।
তিনি বলেন, “আমরা যা যৌক্তিক তা নিয়ে এবং তার পক্ষে কথা বলবো আমরা সবসময় এটা করে আসছি।”মির্জা ফখরুল বলেন, “দেশের মানুষ যখন নিজেদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তা আমাদের অনেক আশা জাগায়।”
তিনি বলেন, “যৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনকে আমরা সমর্থন করি। আমরা এটাকে অযৌক্তিক মনে করার কোনো কারণ দেখছি না।”
কোটা পদ্ধতি প্রসঙ্গে আপিল বিভাগ
এদিকে, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের চলমান ‘বাংলা ব্লকেডের’ মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের ওপর ৪ সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়েছে আপিল বিভাগ।
বুধবার (১০ জুলাই) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ৫ বিচারপতির বেঞ্চ কোটা সংস্কার নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থীর করা আবেদনের শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
শিক্ষার্থীদের পক্ষের আইনজীবী জহিরুল ইসলাম জানান, হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে ৪ সপ্তাহের মধ্যে লিভ-টু-আপিল করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আর, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহবান জানিয়েছে।
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের দেয়া আদেশ স্থগিত চেয়ে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) আপিল বিভাগে আবেদন করেন ২ জন কোটা আন্দোলনকারী। বুধবার (১০ জুলাই) আপিল বিভাগ এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করে চেম্বার আদালত।
এর আগে ৪ জুলাই রিট আবেদনকারীর আইনজীবী অনুপস্থিত থাকায় হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি মুলতবি করে আপিল বিভাগ।
উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে এ বছরের ৫ জুন রায় দেয় হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন চেম্বার আদালত হয়ে ৪ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য আসে। রিট আবেদনকারী পক্ষের সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন আপিল বিভাগ নট টুডে (৪ জুলাই নয়) বলে আদেশ দেয়। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলা হয়।
এ অবস্থায় কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থী ৯ জুলাই আবেদন করেন। দুই শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন শুনানির জন্য ১০ জুলাই আপিল বিভাগে ওঠে। শুনানি শেষে স্থিতাবস্থার আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।