নরেন্দ্র মোদীঃ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর প্রথম মস্কো সফরে পুতিনের সাথে দীর্ঘ বৈঠক 

ক্রেমলিনে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর এক অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (বাঁয়ে) এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফটোঃ ৯ জুলাই, ২০২৪।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মঙ্গলবার মস্কোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এমন এক সময়ে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর করার চেষ্টা করা হচ্ছে যখন পশ্চিমা সামরিক জোট নেটোর নেতারা ওয়াশিংটনে সমবেত হয়েছে এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার মারাত্মক হামলা একটি শিশু হাসপাতালে আঘাত হেনেছে।

“আমাদের সম্পর্ক একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদারিত্বের মধ্যে একটি,” পুতিন মোদীকে বলেন, যিনি ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসনের পর এই প্রথমবার রাশিয়া সফর করছেন।

ইউক্রেন আগ্রাসন নিয়ে মোদী রাশিয়াকে নিন্দা করা এড়িয়ে গেছেন এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দিয়েছেন। ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই সোমবার সেখানে পৌঁছান মোদী।

ইউক্রেন নিয়ে আলোচনা

মঙ্গলবার পুতিনের সাথে চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বৈঠকের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মোদী রক্তপাতের দিকে ইঙ্গিত করেন।

“যুদ্ধ হোক, লড়াই হোক বা সন্ত্রাসবাদী হামলা, যখন প্রাণহানি হয়, মানবতায় বিশ্বাস করা প্রতিটি মানুষই ব্যথিত হয়, ” ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন। “যখন নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা হয়, যখন নিষ্পাপ শিশুদের মারা যেতে দেখি, তখন হৃদয় ব্যথিত হয়। আর সেই যন্ত্রণা বড়ই ভয়ংকর।”

মোদী বলেন, দুই নেতা “ইউক্রেন সম্পর্কে আমাদের মতামত খোলা হৃদয়ে এবং বিস্তারিতভাবে একে অপরকে জানিয়েছি। আমরা শ্রদ্ধার সাথে একে অপরের কথা শুনেছি।”

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে সোমবার (৮ জুলাই) রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ভবনের ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করা হচ্ছে। ফটোঃ ৯ জুলাই, ২০২৪।

মোদী বলেন, “যুদ্ধের ময়দানে সমাধান সম্ভব নয়। বোমা, বন্দুক ও গোলাগুলির মধ্যে সমাধান ও শান্তি আলোচনা সফল হতে পারে না। আর আলোচনার মাধ্যমেই আমাদের শান্তির পথ অবলম্বন করতে হবে।”

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্টড় দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে মোদীর সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, “রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আমরা সরাসরি ভারতের কাছে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছি। সুতরাং আমরা আশা করবো, ভারত এবং অন্য কোনো দেশ যখন রাশিয়ার সাথে জড়িত হবে তখন তারা স্পষ্ট করে দেবে যে, রাশিয়ার জাতিসংঘের সনদকে সম্মান করা উচিত, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখন্ডতাকে সম্মান করা উচিত।”

টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে পুতিন বলেন, মোদির সাথে ‘সব ইস্যু’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ক্রেমলিনের দেয়ালে অজ্ঞাত সৈনিকের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ মোদীর এই সফর ভারতে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলো যখন রাশিয়ার উপর এক রাশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তখন পুতিন উল্লেখ করেন যে, রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্য গত বছর ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি যোগ করেন যে, এটা মোদীর সফরের গুরুত্বপূর্ণ দিক।

মোদী বলেন রাশিয়ার‍ সমর্থনের জন্য, “আমরা ভারতের জনগণকে পেট্রোল এবং ডিজেল সংক্রান্ত সমস্যা থেকে রক্ষা করতে পেরেছি।” তিনি বলেন, জ্বালানী নিয়ে তাদের দেশের চুক্তি “পরোক্ষভাবে বিশ্বে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। ”

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ভ্লাদিমির পুতিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে "দ্য অর্ডার অফ সেন্ট অ্যান্ড্রু দ্য অ্যাপোসল দ্য ফার্স্ট কল্ড' পুরস্কারে ভূষিত করছেন। ফটোঃ ৯ জুলাই, ২০২৪।

ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মিডিয়া জানায়, মস্কো ভারতকে আরও পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা করার বিষয়ও তাঁরা আলোচনা করবেন। দু’দেশ ইতোমধ্যে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিল নাডুতে কুদানকুলাম পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে সহযোগিতা করছে।

‘ঠাণ্ডা লড়াই’ এর সময় ভারতের সাথে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে মস্কোর কাছে নয়া দিল্লির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ফলে রাশিয়ার রফতানির জন্য পশ্চিমা বাজারগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকে চীন এবং ভারত রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হয়ে উঠে। বিশ্লেষকদের মতে, ভারত এখন তার তেল আমদানির ৪০ শতাংশ আনছে রাশিয়া থেকে।

মোদী শেষ বার রাশিয়া সফর করেছিলেন ২০১৯ সালে, যখন তিনি পূর্বাঞ্চলীয় বন্দর নগর ভ্লাদিভস্তকে একটি ফোরামে অংশ নিয়েছিলেন এবং পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাঁরা ২০২২ সালে উজবেকিস্তানে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের শীর্ষ সম্মেলনের সময় বৈঠক করেছিলেন।

ধারনা করা হচ্ছে মোদী রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখবেন। রাশিয়া ভারতের জন্য অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র সরবরাহকারী।

মস্কোর অস্ত্র শিল্প এখন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূলত রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর জন্য সরঞ্জাম প্রস্তুত করছে। সেই পটভূমিতে ভারত যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, ফ্রান্স এবং ইতালি থেকে বেশি অস্ত্র কিনছে।

বাণিজ্য সম্প্রসারণও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে ভারতের চেন্নাই বন্দর এবং ভ্লাদিভস্তকের মাঝে একটি সামুদ্রিক করিডোর গড়ে তোলার লক্ষ্য।

ভারত-রাশিয়া বাণিজ্যে ব্যাপক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জ্বালানী খাতে সহযোগিতার কারণে প্রায় ৬,৫০০ কোটি ডলারে পৌঁছায়, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ভিনায় মোহন কওয়াতরা বলেন