বেনজীরকাণ্ড: বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক প্রধান (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা হরহামেশা শোনা গেলেও দেশটির সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের জমি দখলের খবরে সবকিছু যেন ছাপিয়ে গেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, বেনজীর আহমেদের মতো অনেক ‘রাঘববোয়ালই’ আছেন, যারা সংখ্যালঘুদের জমি ‘নিয়মিত’ দখল করেন। কিন্তু সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা যেভাবে প্রশাসনকে ব্যবহার করে ‘গণহারে’ জমি দখল করেছেন, সেটা তাদের জন্য ‘নতুন উদ্বেগের’ বিষয়।

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে প্রথম অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করে দেশটির বাংলা দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ । গণমাধ্যমটির উপসম্পাদক হায়দার আলী দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানের পর সংবাদটি প্রকাশ করেন। হায়দার আলী ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁর প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখতে পারেননি।

তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের স্ত্রী এবং কন্যার নামে গোপালগঞ্জের সাহাপুরে বিশাল যে রিসোর্ট, এগুলোর বেশির ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জমি। আমাদের সমাজে এই মানুষগুলো একটু নিরীহ জীবনযাপন করেন। জমিগুলোর প্রকৃত মূল্য অনেকে পাননি। তারা জমি বিক্রি করতে চাননি, জোর করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদকে সহযোগিতা করেছেন। এই অবস্থায় সংখ্যালঘু মানুষগুলোর কিছুই করার ছিল না।”

‘‘অনুসন্ধানের সময় আমি যখন তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, কেউই মুখ খুলতে চাননি। ওই সময় তাদের চোখেমুখে আতঙ্ক আর কান্না দেখেছি। কিন্তু সেসব লিখতে পারিনি। কারণ, প্রথমদিকে তাদের কথা লিখলে মানুষগুলোর সমস্যা হতে পারত। আমার রিপোর্টের পর কিছু মানুষ মুখ খুলতে শুরু করলে, তাদের ওপর হামলাও হয়। শুধু সাহাপুর নয়; মাদারীপুর, গাজীপুরেও একই অবস্থা।”

হায়দার আলীর ওই প্রতিবেদনের পর বাংলাদেশের প্রায় সব গণমাধ্যমই বেনজীরকে নিয়ে সরব হয়। তখন সংখ্যালঘুদের ওপর বেনজীরের এই দখল-বাণিজ্যের আসল চিত্র বোঝা যায়। প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে প্রায় ৬০০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। এসব জমির প্রায় সবই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা বলছেন, জমি বিক্রি ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না। ভয় দেখিয়ে, জোর করে এবং নানা কৌশলে তাদের কাছ থেকে জমিগুলো কেনা হয়েছে।”

গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর কিংবা গাজীপুরের মতো পাহাড়ি এলাকায়ও জমি দখল করেছেন বেনজীর আহমেদ। অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘বান্দরবানের সুয়ালক ও লামার ডলুছ‌ড়িতে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেন‌জীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও মে‌য়ের না‌মে রয়েছে শত একর জমি। স্থানীয়দের কাছে এস‌পির জায়গা নামে পরিচিত এসব জমিতে র‌য়ে‌ছে মা‌ছের প্রজেক্ট, গরুর খামার, ফ‌লের বাগান ও রেস্টরুমসহ প্রায় ক‌য়েক কো‌টি টাকার সম্পত্তি। এসব জমিতে একসময় অসহায় পরিবারের বসবাস থাকলেও নামমাত্র মূল্যে তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি জায়গাগু‌লো ফি‌রে পে‌তে সরকা‌রের কা‌ছে দা‌বি তু‌লে‌ছে অসহায় প‌রিবারগু‌লো।”

দুদকের বক্তব্য

বেনজীর আহমেদের এসব কর্মকাণ্ডের কথা গণমাধ্যমগুলো খোলাখুলি প্রকাশ করলেও দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, বেনজীরকে এখনই অভিযুক্ত বলা যাবে না। কমিশনের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, ‘‘দেখুন, বেনজীর আহমেদ কিন্তু এখনও অভিযুক্ত হননি। ওনার বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান মাঝ পর্যায়ে রয়েছে। শেষ হওয়ার আগে কিছুই বলা যাবে না। প্রতিবেদন দেখে দুদক সিদ্ধান্ত নেবে মামলা হবে কিনা। তদন্ত প্রতিবেদন এই মুহূর্তে দেখার সুযোগ নেই। তাই এটাও এখনই বলা যাচ্ছে না যে সংখ্যালঘুদের জমি দখলের বিষয়ে আমাদের মন্তব্য কী হবে।”

বেনজীর আহমেদের এসব কাজে স্থানীয় কিছু পুলিশ কর্মকর্তা সাহায্য করেছেন বলে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান চলছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘‘সব অভিযোগেরই অনুসন্ধান চলছে।”

বেনজীরের কাছে জমি বিক্রি করেছেন, এমন কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের পর বেনজীর তাদের চুপ থাকতে নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়েছেন। তবে শুরুর দিকে অন্য লোক দিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বড়খোলা গ্রামের সরস্বতী রায় বলছিলেন, ‘‘আমার ৩১ শতাংশ জমি বিক্রি করতি বাধ্য অইছি। আমাগে ভয় দেহাইয়ে জমি নিয়ে গেইছে। আমরা জমি ফেরত চাই।”

সংখ্যালঘু নেতাদের প্রতিক্রিয়া

বেনজীরকাণ্ড গণমাধ্যমে আসার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা। কয়েকটি সংগঠন ভুক্তভোগীদের এলাকা পরিদর্শন করেছে। তাদের একজন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।

তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত সংখ্যালঘুদের জমি যেভাবে দখল হচ্ছে, এই দখলি প্রবণতার সঙ্গে আমাদের দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যুক্ত। যখন যে সরকার থাকে, সেই সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই তারা মুভ করে। বেনজীর হচ্ছে এখানে বড় উদাহরণ।”

‘‘আমি গোপালগঞ্জে গিয়ে ভুক্তভোগী সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রায় ৬০০ বিঘার মতো জমি, যার প্রায় সবটুকুর মালিকই হিন্দুরা। গাজীপুরেও একই অবস্থা। সেখানে হিন্দু এবং খ্রিস্টানদের জমি রয়েছে। বেনজীর মূলত সংখ্যালঘুদের জায়গাই দখল করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এটা নিত্যদিনকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তবে বেনজীর যেভাবে প্রশাসনকে ব্যবহার করে গণহারে জমি দখল করেছে, তাতে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।”

“অনেক মানুষই তাদের জমি এখন ফেরত চাইছেন,’’ জানিয়ে রানা দাশ গুপ্ত বলেন, ‘‘জমি ফেরত পেতে হলে এখানে সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দরকার আছে।”

পাহাড়ের অবস্থার কথা জানিয়ে সিএইচটি হেডম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি বিজয় চাকমা বলেন, ‘‘শুধু বেনজীর আহমেদ না, আমাদের এখানে অনেক আহমেদ জমি দখল করে নিয়েছে। পাহাড়ে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে এই ঝামেলাগুলো হচ্ছে। বেনজীর আহমেদ একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় ওনার সামনে কথা বলার লোক ছিল না। এখন মিডিয়ায় বিষয়টি আসায় আদিবাসীরা ক্ষুব্ধ। বেনজীর আহমেদের মতো অনেক রাঘববোয়াল জমি দখল করে আছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস আমাদের নেই।”