প্রায় কুড়ি বছরেরও বেশি সময় আগে ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি জুম্মার নামাজের সময়ে জনগণের সামনে যুক্তরাষ্ট্রে মোহমুক্ত ভোটদাতাদের কথা উল্লেখ করে দেশটির প্রতি নিন্দা জানিয়েছিলেন ।
২০০১ সালে খামেনি বলেছিলেন, “ এটা লজ্জার বিষয় ৩৫% কিংবা ৪০% ভোটদাতা ভোট দিচ্ছেন, যেমনটি আপনারা কোন কোন দেশে দেখেন যেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে। এটা পরিস্কার যে তাদের জনগণ তাদের রাজনৈতিক পদ্ধতির উপর আস্থা রাখে না, তারা এটার কোন তোয়াক্কা করে না এবং এ নিয়ে তাদের কোন আশা নেই”।
আয়াতুল্লাহ যে কথা বলেছিলেন, ইরান এখন তারই সম্মুখীন।
ইরানে শুক্রবার ফিরতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পর এই দ্বিতীয়বার ফিরতি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে মাত্র ৩৯.৯% ভোটদাতা তাদের ভোট দিয়েছেন। মোট ভোটের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৫ লক্ষেরও বেশি।
আর এর মধ্যে ১০ লক্ষেরও বেশি ব্যালট পরে বাতিল করা হয়- এতে বোঝা যায় লোকজন ভোট দিতে যাওয়াকে দায়িত্ব মনে করেন কিন্তু শেষ অবধি সকল প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করতে চান।
ইতোমধ্যেই ইরানের অর্থনীতির নতুন করে পতন ঘটছে, ২০২২ সালে মাহসা আমিনকে হিজাব না পরার জন্য দেশের নীতি-পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে ব্যাপক প্রতিবাদ হয় তা ছাড়াও ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সহিংস অভিযান।
ইরান যখন অস্ত্র-নির্মাণ স্তরের ইউরেনিয়াম পরিশোধনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তখন পশ্চিমের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরমাণু বিষয়ক সাবেক আলোচক কট্টরপন্থি সাঈদ জালিলি সংস্কারপন্থি মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। পেজেশকিয়ান হৃদ-বিশেষজ্ঞ সার্জন এবং প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভের জন্য তিনি আশা করছেন বিপুল সংখ্যক লোক ভোট দেবেন।
পেজেশকিয়ানের সমর্থকরা জালিলির অধীনে খারাপ দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে অনেকেই মনে করছেন যে তাদের ভোটে কিছু যায় আসে না।
গ্রাফিক ডিজাইনে অধ্যয়নরত ২৩ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লেইলা সেইদী বলেন, “ আমি ভোট দিই নাই এবং দিবো না কারণ মাহসার ঘটনার জন্য এবং তরুণরা এখনও যে সমস্যার সম্মুখীন তার জন্য কেউ ক্ষমা চায়নি, সংস্কারপন্থিরা নয়, কট্টরপন্থিরাও নয়”।
ইরানের নির্বাচনী আইনে ফিরতি নির্বাচনের যাতে কোন দরকার না হয় সে জন্য একজন প্রার্থীকে ৫০% ভোট পেতে হবে। শনিবার প্রকাশিত ফলাফলে পেজেশকিয়ান ১ কোটি ৪ লক্ষ ভোট পান, জালিলি পান ৯৪ লক্ষ ভোট। তৃতীয় স্থানে ছিলেন সংসদের স্পিকার মোহাম্মদ বাঘের ক্বালিবাফ। তিনি পান ৩৩ লক্ষ ভোট আর শিয়া ধর্মীয় নেতা মোস্তফা পোরমোহাম্মাদী পান ২ লক্ষ ৬ হাজার ভোট।
বিশ্লেষকরা বলছেন ইরানের আধা-সামরিক রিভ্যুলিউশানারী গার্ডের সাবেক জেনারেল ও জাতীয় পুলিশ প্রধান ক্বাবিলাফ, যিনি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এবং দূর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য পরিচিত তার সমর্থক ভোটদাতারা সম্ভবত জালিলিকেই ভোট দেবেন কারণ ক্বাবিলাফ জালিলির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
এর ফলে জালিলি এই ফিরতি নির্বাচনে শীর্ষ স্থানে চলে যেতে পারেন। ৫৮ বছর বয়সী জালিলি ১৯৮০’র দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় তাঁর একটি পা হারানোর কারণে একজন “ জীবিত শহীদ” হিসেবে পরিচিত।
তবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচী নিয়ে আলোচনার সময়ে পশ্চিমি কুটনীতিকদের কাছে তার হঠকারিতার বদনাম এবং দেশের ভেতরেও তার মতবাদ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। একজন রাজনীতিক, যিনি নিজেকে মধ্যপন্থিদের সঙ্গে একাত্ম করেছেন তিনি হচ্ছেন ইরানের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ জাভাদ আজারি জাহরোমি।
তিনি জালিলি ও পেজেশকিয়ানের মধ্যে বাছাই করার বিষয়টিকে খুব কঠিন বলে বর্ণনা করেছেন।
তিনি সামাজিক প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, “ আমরা ইরানকে তালিবানের হাতে তুলে দিতে দিবো না”।
তবে এমন কঠোর সতর্কবার্তা সত্ত্বেও এর কোন প্রভাব পড়েনি। ২৮ জুনের ভোটের পর তেহরানের রাস্তায় অনেকেই দ্য এসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেছেন তারা নির্বাচনের কোন তোয়াক্কা করেন না।
২৭ বছর বয়সী মনস্তত্ত্বের শিক্ষার্থী আহমাদ তাহেরী বলেন, “ আগের প্রেসিডেন্টরা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হন তাই আমি ভোট দিই নাই। এই শুক্রবার আমি ভোট দেবো না”।
৪৩ বছর বয়সী একজন বিদ্যুত্ প্রকৌশলী, যিনি দুই সন্তানের জনক, মোহাম্মদ আলী রোবাতি বলেন মানুষের অর্থনৈতিক চাপের বিষয়ে ইরানি কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেই তিনি ভোট দিবেন না।
রোবাতি বলেন, “ অনেক বছর ধরে এই অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে, রাজনীতির ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই”। তবে তিনি শুক্রবার ভোট দেয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দেননি।
বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ২০১৫ সালে ইরানের পরমাণু চুক্তির সময়ে ইরানের মুদ্রার মান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ১ ডলারের বিনিময়ে ৩২,০০০ রিয়াল। বর্তমানে এর মূল্য হচ্ছে ১ ডলারের বিনিময়ে ৬,১৭,০০০ রিয়াল।
অনেকেই বলছেন তাদের ব্যাংকের হিসেব, অবসর ভাতা এবং অন্যান্য সম্পদ , বহু বছর ধরে মুদ্রার মূল্যমান হ্রাসের ফল। এপ্রিল মাসে ইসরায়েলের উপর ইরানের নজিরবিহীন সরাসরি আক্রমণের পর মুদ্রার মান রেকর্ড পরিমাণ যে নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল ৭,০০.০০০ রিয়ালে। আশংকা করা হচ্ছে আবার এই পর্যায়ে ইরানের মুদ্রামান নেমে আসতে পারে।