ব্রিটেন নির্বাচনে যাচ্ছে বিরোধী লেবার পার্টির প্রত্যাশিত বিজয় সামনে রেখে

ব্রিটেনের উপকূলীয় ক্ল্যাক্টন-অন-সি শহরে ডানপন্থি রিফর্ম পার্টির একজন কর্মী প্রচারণার কাজে ব্যস্ত। ফটোঃ ২ জুলাই, ২০২৪।

ব্রিটেনে বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই)-এর সাধারণ নির্বাচনে এক ব্যাপক বিজয়ের মাধ্যমে নতুন সরকার নির্বাচিত হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর জনসেবামূলক কর্মসূচীর উপর চাপের মধ্যে এই ভোট হতে যাচ্ছে।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নতুন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং গাজার যুদ্ধ।

জনমত জরীপে কির স্টারমারের নেতৃতে বিরোধীদল লেবার পার্টি ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভ দলের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি সমর্থন পাচ্ছে। কনজারভেটিভ পার্টি গত ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে, যে সময় ছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বাক-বিতণ্ডার মাঝে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসা এবং করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় প্রবল-সমালোচিত পদক্ষেপ।

“কনজারভেটিভদের নিয়ে ব্যাপক এবং গভীর অসন্তোষ রয়েছে,” বলছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ উরসুলা হ্যাকেট। “দৈনন্দিন খরচের প্রশ্নটা এখানে আছে, কিন্তু আমার মনে হয় এখানে কেলেঙ্কারি আর অনৈতিক আচরণের বিষয়টিও আছে,” তিনি দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন।

লেবার যদিও নির্বাচনের আগে উৎফুল্ল মেজাজে আছে, বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন যে, ভোটারদের অসন্তোষ পুরো রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়েই। প্রধান বিরোধী দল বা তাদের নেতা স্টারমার নিয়ে ইতিবাচক উৎসাহের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

বিশাল বিজয়ের পথে লেবার পার্টি নেতা কির স্টারমার। ফটোঃ ২ জুলাই, ২০২৪।

ভোটার অসন্তোষ

লন্ডনের পূর্ব দিকে ডার্টফোরড শহরকে বলা হয় “আবহাওয়া নির্দেশক” সংসদীয় এলাকা। এই এলাকার ভোটাররা ১৯৬৪ সাল থেকে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী দলের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে। দেশের সার্বিক হাওয়া কোন দিকে বইছে, তা ডার্টফোরডকে দেখে বোঝা যায়।

আঠারো বছর বয়স্ক ইয়াসমিন নিকোলস প্রথমবারের মত ভোট দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে – কিন্তু ইতোমধ্যেই তার মোহ ভঙ্গ হয়েছে।

“দেশে কী হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসলে ইংল্যান্ডের মানুষ নেয় না ... অনেক বিষয়ে আমাদের বলতে দেয়া হয় না, আমরা শুধু অনুসরণ করি,” তিনি বলেন।

অবসরপ্রাপ্ত দোকান কর্মী লিন্ডা স্কিনার, যার বয়স ৬৪, সেই মনোভাবের প্রতিধ্বনি করলেন। “সরকার আর জনগণের জন্য নয়। সত্যি কথা বলতে, আমি অনেক দিন হল ভোট দেই না। আমাদের ভোটের কোন মূল্য নেই। একই লোক প্রতিবার ক্ষমতায় আসে – লেবার, কনজারভেটিভ, তারা সব একই,” তিনি এপিকে বলেন।

প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকঃ দলের 'অনৈতিক আচরণের' ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলতে বেগ পেতে হচ্ছে। ফটোঃ ২ জুলাই, ২০২৪।

অনেকের মতে, এই অনাস্থার জন্য দায়ী সাম্প্রতিক সময়ের কিছু রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি।

“আমি তাদের কাউকে বিশ্বাস করি না। বিশেষ করে যখন আমাদের (প্রাক্তন) প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মিথ্যা কথা বলে। তিনি সব কিছু নিয়ে মিথ্যা বলেছেন। যখন সবাই লকডাউনের কারণে বাসায় বসে, তখন তিনি পার্টি করছেন। সেই মুহূর্তের পর থেকে, ব্যস, আমার জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল,” বললেন পেনশন গ্রহণকারী হিলমি হিলমি।

কেলেঙ্কারি

গত বছর কোভিড-১৯ লকডাউন নিয়ম ভঙ্গ সহ কয়েকটি কেলেঙ্কারির পর জনসন পদত্যাগ করেন। জনসন ছিলেন গত আট বছরে পাঁচটি ভিন্ন কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রীর একজন।

বিশ্লেষকরা বলেন, এই ভাবমূর্তি ঝেরে ফেলতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সুনাকের অসুবিধা হচ্ছে, যখন ব্রিটেনের গ্যাম্বলিং কমিশন নতুন করে কনজারভেটিভ সদস্যদের তদন্ত করছে যারা আসন্ন নির্বাচনের তারিখ নিয়ে বাজি ধরেছিলেন।

বরিস জনসনঃ গত আট বছরে পাঁচ কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রীর একজন। ফটোঃ ২ জুলাই, ২০২৪।

দুর্বল অর্থনীতি

স্টারমারের নেতৃতে বিরোধী লেবার পার্টি জনমত জরীপে অনেক এগিয়ে আছে। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নিয়ে পাবেন সমস্যা-জর্জরিত এক অর্থনীতি, বলছেন লন্ডনের কিং’স কলেজের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক আনান্দ মেনন।

“বছরের পর বছর পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে জনসেবা গুলো ধসে পড়ছে। বিগত ১০ থেকে ১৫ বছরে মানুষের মধ্যমা আয়ের প্রবৃদ্ধি খুবই ধীরে হয়েছে। কাজেই, এখানে জনগণ ক্রমশ অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

“একই সাথে, এই সব সমস্যা মোকাবেলার জন্য আমাদের খুব কম অর্থ আছে। করের বোঝা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ঋণ পরিশোধের মাত্রা উঁচু, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি খুবই কম। স্টারমার সরকারের সামনে প্রথম কয়েকটি বড় প্রশ্নের মধ্যে একটি হবে, ধসে পড়া জনসেবা ঠিক করার জন্য টাকা কোথা থেকে পাবেন?” মেনন ভিওএকে বলেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেস্কির সাথে কির স্টারমার। ফাইল ফটোঃ ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩।

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ

আগামী সরকারের সামনে আরও থাকবে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মারাত্মক তালিকা। ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমা দেশের সামরিক সাহায্য নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে এমন সময়ে, যখন কিয়েভ রুশ বাহিনীর কাছ থেকে হারানো এলাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছে।

গাজায় ব্যাপক প্রাণহানির মাঝে লেবার পার্টির সদস্যরা দাবী করছে স্টারমার যেন ইসরায়েলি সরকারের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করে। স্টারমার বলেছেন, তিনি সার্বিক শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে চান।

পশ্চিমা বিশ্বের জন্য চীন অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, বিশ্লেষক মেনন বলেন, ব্রিটেনের মিত্রদের উচিত হবে না পররাষ্ট্রনীতিতে কোন নাটকীয় পরিবর্তনের আশা করা।

“এই মুহূর্তে ব্রিটিশ রাজনীতির সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে, আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় দুই সঙ্কট, গাজা এবং ইউক্রেন, এই দুই বিষয়ে দুই বড় দলের অবস্থানের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। কাজেই, আমি মনে করি না যে এখানে কোন পরিবর্তন আসবে,” মেনন বলেন।

লিবেরাল ডেমক্র্যাটসদের নেতা এড ডেভি দ্বিতীয় স্থানে আসার আশা করছেন। ফটোঃ ১ জুলাই, ২০২৪।

ছোট দল

ব্রিটেনের তুলনামূলক ছোট দলগুলো নির্বাচনের ফলাফল এবং লেবার পার্টির প্রত্যাশিত জয়ের মাত্রা নির্ধারণ করতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। মধ্য-বাম পন্থী লিবেরাল ডেমক্র্যাটসদের সুযোগ আছে কনজারভেটিভদের তৃতীয় স্থানে ঠেলে দেয়ার।

অভিবাসন-বিরোধী, বেক্সিটপন্থী ইউকে রিফর্ম পার্টিও কনজারভেটিভদের ডানপন্থী ভোটারদের তাদের দিকে টেনে নিতে পারে।

রিফর্ম নেতা নাইজেল ফারাজ সম্প্রতি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে দায়ী করলে তাঁকে অন্যান্য দল তীব্র সমালোচনা করে।

রিফর্ম সবার তরফ থেকেই সমালোচনার মুখে পড়ে, যখন দলের কিছু কর্মীকে সম্প্রতি গোপনে ফিল্ম করা হয় যেখানে তারা বর্ণবাদী গালিগালাজ ব্যবহার করছিলেন।