দোহায় জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা সম্পন্ন; তালিবানের প্রতি স্বীকৃতি এখনও স্বপ্নই কেবল

আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের জাবিউল্লাহ মুজাহিদ (মাঝে ডানে) রাশিয়ার দূত জামির কাবুলভের সঙ্গে কথা বলছেন। দোহা, কাতার। জুন ৩০,২০২৪। (এপি’র মাধ্যমে তালিবান মুখপাত্রের দপ্তর)

আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার উপায় সন্ধানের বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে তৃতীয় দফা আলোচনা সমাপ্ত হয়েছে তবে তালিবান কোন রকম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়নি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোন ধরণের ছাড়ও পায়নি।

কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং আফগানিস্তান বিষয়ে প্রায় দুই ডজন রাষ্ট্রের দূতেরা তালিবান কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাতারের দোহায় দু’দিন ব্যাপী এই বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকের সভাপতি রাজনৈতিক ও শান্তি প্রতিষ্ঠা বিষয়ক জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রোজম্যারি ডি কার্লো সংবাদদাতাদের জানান যে এই আলোচনা ছিল “গঠনমুলক” এবং “প্রযোজনীয়”।

ডি কার্লো বলেন, “ এই প্রথম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ এবং (আফগানিস্তানের) ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের এমন বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। এই আলোচনা ছিল খোলামেলা এবং, আমার বিশ্বাস, প্রয়োজনীয়”।

এক বছর আগে এই “দোহা প্রক্রিয়া”র সূচনা করেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ।

এই সর্বসাম্প্রতিক দফার আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা এই যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে র াজি হলেও, তালিবান নারী শিক্ষা ও জনজীবনে তাদের অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেওয়া অবধি ডিকার্লো কাবুলের ক্ষমতাসীন শাসকদের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা নাকচ করে দিয়েছেন।

নিজ নিজ দেশের সিদ্ধান্ত

জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন, “ আফগানিস্তান যদি তার জনসংখ্যার অর্ধেকের অবদান ও সম্ভাবনা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখে তা হলে দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরে আসতে পারবে না কিংবা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে সম্পুর্ণ ভাবে নিজেকে উন্নত করতে পারবে না”। তিনি আরও বলেন যে তালিবানের শাসনের বিষয়ে এই আন্তর্জাতিক সংঠনের কোন নির্দেশনা নয়, নির্ভর করছে নিজ নিজ দেশের সিদ্ধান্তের উপর।

আফগানিস্তানে যদিও প্রায় ১৬টি রাষ্ট্রের দূতাবাস রয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না কারণ এ সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক নয় এবং সে দেশে নারী ও শিশুদের অধিকারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।

নারীর অধিকার যদিও আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচীতে ছিল না, ডিকার্লো বলেন আলোচনার সবটুকু জুড়েই অংশগ্রহণকারীরা এই বিষয়টা উত্থাপন করেন এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক সরকারের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেন। দু’দিন ব্যাপী এই আলোচনায় বেসরকারি ব্যবসা ক্ষেত্র এবং মাদক বিরোধী অভিযানে তালিবানের অর্জন বহাল রাখতে সাহায্য করার উপর আলোকপাত করা হয়।

আলোচনার পর তালিবানের প্রতিনিধিদলের প্রধান জাবিউল্লাহ মুজাহিদ সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম এক্স’এ বলেন, “ আফগানিস্তারে বার্তাটি অংশগ্রহণকারী সকল দেশের কাছে পৌঁছেছে”। তিনি বলেন তার দেশ চায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।

পটভূমি সম্পর্কে পশ্চিমের একজন কুটনীতিক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন আফগান প্রতিনিধিদলের সদস্যরা “ খুবই দক্ষ” এবং তাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান অত্যন্ত “আকর্ষনীয়”।

এক্স এ পূর্ববর্তী এক পোস্টে তালিবানের এই প্রধান মুখপাত্র মুজাহিদ সাফল্য দাবি করেন। পোস্টে বলা হয়, “ এমন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে”।

যদিও শতাধিক তালিবান সদস্য আর্থিক নিষেধাজ্ঞাসহ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে কিন্তু আফগানিস্তানে ব্যাংকগুলি নিষেধাজ্ঞামুক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং আর্থিক লেনদেনের প্রধান ব্যবস্থা SWIFT থেকে বিচ্ছিন্ন কারণ পশ্চিমের ব্যাংকগুলি আফগান ব্যাংকগুলির সাথে কাজ করতে এবং তারা যে খ্যাতি ও আর্থিক ঝুঁকিসমুহের সমুখীন সেখানে নিজেদের প্রকাশ করতে আংশকিা বোধ করছে।

এই আলোচনায় একান্ত ভাবে পশ্চিমি কুটনীতিক বলেন কোন দেশ কোন নতুন নীতি চালু করেনি।

২০২১ সালের আগস্ট মাসে তালিবান দেশটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংক তহবিলের ৯৫০ কোটি ডলার আটকে দিয়েছে। ২০২২ সালে বাইডেন প্রশাসন ওই অর্থের মধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার সুইটজারল্যান্ড ভিত্তিক একটি ট্রাস্ট হিসেবে নিয়ে আসেন। ওই হিসেবের নাম, “ ফান্ড ফর দ্য আফগান পিপল” যেটির তত্বাবধান করে একটি ট্রাস্ট। অবশিষ্ট অর্থ আটকে রাখা হয়েছে। চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ইরান ওই তহবিল অবমুক্ত করার বিষয়টি সমর্থন করে।

‘এটি বুঝতে পারার বিষয়’

সোমবার দিনের শেষে, মুজাহিদ বলেন, সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন কিছু মনে করে তালিবান আসেনি।

তালিবান ও পশ্চিমের মধ্যে বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কোন অগ্রগতি ন া হওয়া সম্পর্কে ভয়েস অফ আমেরিকার এক প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেন, “ অগ্রগতি এটাই যে প্রত্যেকটি দেশ আফগানিস্তানকে সাহায্য করতে চায়”।

এই বৈশ্বিক বৈঠকে তালিবানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আফগান নাগরিক সমাজের সক্রিয়বাদীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জাতিসংঘ অধিকার কর্মীদের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।

ডিকার্লো বলেন, “[আলোচনার] এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার ব্যাপারে আমাদের অনুমোদন রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস ছিল ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষকে এবং বিশেষ দূতদের সরাসরি আলোচনায় একত্রে বসানো। দূর্ভাগ্যবশত ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ এই আলোচনায় আফগান নাগরিক সমাজের সঙ্গে বসবে না”।

যখন জানতে চাওয়া হয় যে ভবিষ্যতে তালিবানকে আলোচনার টেবিলে আনতে এই বিশ্বসংগঠন কি ধরণের ছাড় দিতে রাজি হবে, ডিকার্লো বলেন ক্ষমতাসীন শাসকরা কি শর্ত আরোপ করতে চান সে ব্যাপারে তিনি কোন পূর্বাভাস করতে পারছেন না”।

তিনি বলেন, “ এ নিয়ে আমি কোন আঁচ-অনুমান করতে পারবো না।আমি এটুকুই কেবল বলতে পারি যে তারা আজ এসেছিল। তারা অত্যন্ত সম্পৃক্ত ছিল”।

অন্তত তিন জন প্রখ্যাত আফগান নারী দোহার এই সম্মেলনে যোগ দেয়ার জাতিসংঘের আমন্ত্রণ মঙ্গলবার প্রত্যাখ্যান করেন।

ডিকার্লো বলেন, “ আমি তাঁদের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানাই। আমরা এখন যে প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রয়েছি সেটি এখন দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এটা খুব সহজে এগিয়ে নেয়ার মতো নয়। আর আমরা যতটা সম্ভব ভাল করার চেষ্টা করবো। আমরা সবাইকে খুষিশ করতে পারবো না”।

তালিবান আরও আলোচনার জন্য ফিরে আসবে কীনা এরকম প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেন, এটা নির্ভর করছে আলোচনার টেবিলে কে এবং কি রয়েছে।

তিনি বলেন, “ আমরা প্রতিটি বৈঠকককে আলাদা করে বিবেচনা করবো। আমরা আলোচ্যসূচী এবং এর লক্ষ্য খতিয়ে দেখবো”।

আফগানিস্তান সম্পর্কে জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন আলোচনার আগামি পর্বের তারিখ এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।