সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করেছেন দেশটির অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে এ কথা বলেন তিনি। প্রত্যয় স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলনের কোনো যুক্তি নেই বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।
উল্লেখ্য, সোমবার (১ জুলাই) থেকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহবানে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের 'বৈষম্যমূলক' পেনশন ব্যবস্থার আওতা থেকে বাদ দেয়ার দাবিতে, বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেছেন।
ওদিকে, আগের শিক্ষকরা প্রত্যয়ের আওতামুক্ত, তাই তাদের আন্দোলন বোধগম্য নয় বলে দাবী করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “সর্বজনীন পেনশন স্কিম 'প্রত্যয়' চালু হয়েছে ১ জুলাই থেকে। যারা নতুনভাবে চাকরিতে যোগ দিবেন তাদের জন্য এটা প্রযোজ্য, যারা চাকুরীরত আছেন তারা এটার আওতামুক্ত। কেননা কাউকে একবার কোনও আর্থিক সুবিধা দিয়ে দিলে সেটা প্রত্যাহার করার সুযোগ নেই।”
অর্থ প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, “যারা চাকরিতে নতুন আসবেন তারা তো সবকিছু জেনে, বুঝে, সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায়, বিনা প্ররোচনায় চাকরিতে যোগদান করবেন। তাহলে চাকুরীরতদের এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার যৌক্তিকতা কি? তারা তো কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না!? আমার বোধগম্য নয়।”
সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “এখন যারা নতুন করে চাকরিতে যোগদান করবে তারা সবাই সার্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় চলে আসবে। যারা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তারা প্রত্যয়ের আওতায় আসবে। সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন আরেকটা স্কিম করা হচ্ছে। সেটাও বোধ আগামী কিছুদিনের মধ্যে আসবে। শেষ পর্যন্ত সরকারি তহবিল থেকে পেনশন দিয়ে তো একটা রাষ্ট্র সারাজীবন চলতে পারে না। ৫০ বছর তো এইভাবে চললাম। আস্তে-আস্তে এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা বন্ধ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “কিছু লোক পেনশন পাবে, আর সাধারণ জনগণ তা পাবে না এটা তো হয় না। সবাইকে এর আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যতে তাই হবে। বৃহত্তর উদ্দেশ্য এটা করা হয়েছে।
"আমাদের উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষমতা নেই"- শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী, নীরব মন্ত্রী
“শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া এবং আন্দোলন নিয়ে কোনও ধরণের উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষমতা নেই” বলে জানিয়েছেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী শামসুন্নাহার চাপা
২ জুন তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “শিক্ষকদের আন্দোলন ও দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। এই বিষয়ে সমধানের কোনও উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষমতা মন্ত্রীর রয়েছে।”
এই নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন প্রতিমন্ত্রী চাপা।
পরে এ নিয়ে কথা বলতে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলকে একাধিকবার ফোন করা হলে এবং মেসেজ দিলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এর আগে, রবিবার (৩০ জুন) শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, শিক্ষকদের আন্দোলনের দিকে নজর রাখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে যথাসময়ে মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে সেশনজটে পড়লে, মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না; এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ে তারা আন্দোলন করছেন। সেই অধিকার তাদের আছে। অনেকে বলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। এ আন্দোলনের মাধ্যমে তো এটা বোঝা যাচ্ছে যে, তারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারেন।”
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সর্বজনীন পেনশনের আওতায় কারা আসবে, সেটা সরকারের নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত। সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আছে। শিক্ষকরা দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে জানাচ্ছেন, সরকারই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখানে আলাদা করে কিছু করার নেই।
পেনশন প্রকল্প
প্রবাসী, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা; এই চারটি প্রকল্প নিয়ে ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন প্রকল্প যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশে। পরে সব স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য 'প্রত্যয় স্কিম' নামে একটি নতুন স্কিম চালু করা হয়।
অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে প্রত্যাবর্তনের আকর্ষণীয় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রিটার্ন পাওয়া তহবিলের প্রতি আস্থা না থাকায় মানুষ খুব ধীর গতিতে নিবন্ধন করছে।
শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন
এদিকে, ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে মঙ্গলবার (২ জুলাই) দ্বিতীয় দিনের মতো সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। একাডেমিক কাজ করতে আসা শিক্ষার্থীরা পড়ছেন চরম ভোগান্তিতে।
সোমবার (১ জুলাই) থেকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহবানে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের 'বৈষম্যমূলক' পেনশন ব্যবস্থার আওতা থেকে বাদ দেয়ার দাবিতে, বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন।
এর আগে রবিবার (৩০ জুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের প্রধান ফটকে এক সংবাদ সম্মেলন করে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচির আওতায়; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত, সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম, প্রফেশনাল প্রোগ্রাম, অনলাইন ক্লাস ও অফলাইন ক্লাস, প্রশাসনিক কাজ এবং সব শ্রেণীর ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
চেয়ারম্যান কার্যালয়, হল প্রভোস্ট অফিস, গবেষণা কেন্দ্র, ইনস্টিটিউট, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ডিন অফিস, কম্পিউটার ল্যাব ও সেমিনার বন্ধ রয়েছে।
একইভাবে, সর্বজনীন পেনশন-সংক্রান্ত 'বৈষম্যমূলক' প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে ধর্মঘট-প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
আন্দোলনকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাশরিক মেহেদী হাসান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “গত ১৩ মার্চ নতুন প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর এটা নিয়ে শিক্ষকদের মতামত জানতে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাক্ষর অভিযান কর্মসূচি পরিচালনা করি আমরা। সব শিক্ষকই স্বাক্ষর করে নতুন স্কিম প্রত্যাখান করেছে। সেটা আমরা মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জমাও দিয়েছি। কিন্তু তা নিয়ে কোনও অগ্রগতি না থাকায় আমরা সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছি।”
মেহেদী হাসান জানান, “প্রথমে আমরা ১ ঘন্টা কর্মবিরতি,তারপর ২ ঘন্টা এবং অর্ধ দিবস কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেছি। পূর্ণাঙ্গ ১ দিনও কর্মবিরতি পালন করেছি। তখন আমরা পরীক্ষাকে কর্মবিরতির আওতা মুক্ত রখেছিলাম। কিন্তু গত ৩ মাসে কর্তৃপক্ষের পক্ষের কাছে যথাযথ সাড়া না পেয়ে এখন সর্বাত্মক কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি।”
“প্রত্যয় স্কিম বাতিল, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণা এবং শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে অন্তরর্ভুক্তি করার দাবিতে আন্দোলন চলছে। এই ৩ দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে”- বলে যোগ করেন মেহেদী হাসান।
এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আদিত্য রিমন।