বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের 'বৈষম্যমূলক' পেনশন ব্যবস্থার আওতা থেকে বাদ দেয়ার দাবিতে, বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেছেন। এর ফলে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
সোমবার (১ জুলাই) থেকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহবানে শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন শুরু করেন। এর আগে রবিবার (৩০ জুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের প্রধান ফটকে এক সংবাদ সম্মেলন করে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
কর্মসূচির আওতায়; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত, সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম, প্রফেশনাল প্রোগ্রাম, অনলাইন ক্লাস ও অফলাইন ক্লাস, প্রশাসনিক কাজ এবং সব শ্রেণীর ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
চেয়ারম্যান কার্যালয়, হল প্রভোস্ট অফিস, গবেষণা কেন্দ্র, ইনস্টিটিউট, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ডিন অফিস, কম্পিউটার ল্যাব ও সেমিনার বন্ধ রয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. শেখ মাশরিক হাসান বলেন, “আমরা বলেছিলাম, আমাদের দাবি মানা না হলে আমরা পুরোপুরি কর্মবিরতিতে যাবো। এখন পর্যন্ত আমাদের দাবি মানা হয়নি। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষাসহ সব দাপ্তরিক কাজ বন্ধ থাকবে। আমরা পূর্বঘোষণা অনুযায়ী কর্মসূচি পালন করছি।”
একইভাবে সর্বজনীন পেনশন-সংক্রান্ত 'বৈষম্যমূলক' প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে ধর্মঘট-প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ
শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) বন্ধ রয়েছে ক্লাস ও পরীক্ষা। সোমবার (১ জুলাই) থেকে সর্বজনীন পেনশন সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রস্তাবিত সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তকরণ এবং স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহবানে কর্মবিরতি পালন করছেন শাবিপ্রবির শিক্ষক সমিতি।
কর্মবিরতিকালে প্রতিদিন দুপুর ১২টা হতে ১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে বলে জানান শিক্ষকরা।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, এই স্কিমে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করলে তা বড় ধরনের ক্ষতি হবে। বেতন থেকে নির্দিষ্ট অংশ কেটে পেনশন দেয়ার পদ্ধতিতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহ হারাবেন।
শাবিপ্রবিতে অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন, সহায়ক এবং সহকারী কর্মচারীরা আলাদাভাবে কর্মবিরতি পালন করছে। বিশ্ব্িদ্যালয়ের সকল দফতর বন্ধ রেখেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে সব ধরনের পরীক্ষা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চুয়েটে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ
সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর ফলে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।
সোমবার (১ জুলাই) থেকে চবির ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে তা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও ভর্তি কমিটির সচিব এস এম আকবর হোছাইন।
সরকারঘোষিত পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহবানে সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে চবি শিক্ষক সমিতি।
এদিকে উদ্বোধনী ক্লাস না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন নবীণ শিক্ষার্থীরা। মোহাম্মদ পরাগ নামে আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের এক শিক্ষার্থী বলেন, “শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে আমাদের ক্লাস হয়নি। কবে হবে, সে বিষয়েও আমাদের কিছু জানানো হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস নিয়ে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিলো।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম আকবর হোছাইন বলেন, “ক্লাস শুরুর বিষয়টি বিভাগের চেয়ারম্যান ও ফ্যাকাল্টির ডিনদের ওপর নির্ভর করে। তাদের কর্মবিরতি পালনের জন্য ক্লাস শুরু করা যায়নি।”
ক্লাস কবে নাগাদ শুরু হতে পারে- জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ-উদ দৌল্লাহ বলেন, “শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে আমরা রবিবার প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু করতে পারিনি। আন্দোলন চলাকালে ক্লাস শুরু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”
চবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ বি এম আবু নোমানের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়, অর্থমন্ত্রণালয়ের সম্প্রতি জারি করা পেনশন সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তিকরণ ও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহবানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করবে।
এদিকে, একই দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষকরাও। এ কারণে চুয়েটের বিভিন্ন বিভাগে চলমান স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সব পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে স্নাতক পর্যায়ে চলমান লেভেল-৩ টার্ম-১ এবং লেভেল-২ টার্ম-১ পরীক্ষা ২০২৩ এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সব পরীক্ষা অনিবার্য কারণবশত স্থগিত ঘোষণা করা হলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, শিক্ষকদের এক সভায় চুয়েটের উপ-উপাচার্য, অধ্যাপক ও বিভিন্ন অনুষদের ডিনদের উপস্থিতিতে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
খুলনার তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতি শুরু
খুলনার তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন শুরু করেছেন। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সোমবার (১ জুলাই) থেকে এ কর্মবিরতি শুরু করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ও খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এস এম ফিরোজের ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রকিবুল হাসান সিদ্দিকী জানান, সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অন্তর্ভুক্তি বাতিলের দাবিতে গত মে মাস থেকে আন্দোলন চলছে। এখনো এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। “আমাদের দাবি পূরণ না হওয়ায়, ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন শুরু করেছি;” জানান তারা।
কর্মবিরতির অংশ হিসেবে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হাসিব।
বক্তারা বলেন, একই বেতনস্কেলে কর্মরত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ভিন্ন নীতি অবলম্বন সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র একই শ্রেণীর কর্মচারীর একটি নির্দিষ্ট অংশকে সুবিধাবঞ্চিত করবে।
পেনশন প্রকল্প
প্রবাসী, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা; এই চারটি প্রকল্প নিয়ে ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন প্রকল্প যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশে। পরে সব স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য 'প্রত্যয় স্কিম' নামে একটি নতুন স্কিম চালু করা হয়।
অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে প্রত্যাবর্তনের আকর্ষণীয় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রিটার্ন পাওয়া তহবিলের প্রতি আস্থা না থাকায় মানুষ খুব ধীর গতিতে নিবন্ধন করছে।
শিক্ষামন্ত্রী যা বললেন
সর্বজনীন পেনশন (প্রত্যয়) স্কিম বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কর্মবিরতির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, শিক্ষকদের এ আন্দোলনের দিকে নজর রাখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে যথাসময়ে মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রবিবার (৩০ জুন) রাজধানী ঢাকার সেগুনবাগিচায় এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।
শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে সেশনজটে পড়লে, মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না; এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ে তারা আন্দোলন করছেন। সেই অধিকার তাদের আছে। অনেকে বলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। এ আন্দোলনের মাধ্যমে তো এটা বোঝা যাচ্ছে যে, তারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারেন।”
শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, “আমরা এই বিষয়ের দিকে নজর রাখছি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা পদক্ষেপ নেবো।”
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সর্বজনীন পেনশনের আওতায় কারা আসবে, সেটা সরকারের নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত। সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আছে। শিক্ষকরা দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে জানাচ্ছেন, সরকারই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখানে আলাদা করে কিছু করার নেই।