টি২০ বিশ্বকাপঃ ভারত চ্যাম্পিয়ন, প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা পরাজিত

শেষ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার ডেভিড মিলার আউট হলে ভিরাট কোহলি (ডানে) এবং হার্দিক পান্ডিয়া উল্লাস করছেন। ফটোঃ ২৯ জুন, ২০২৪।

নবম আইসিসি পুরুষদের টি২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করেছে টুর্নামেন্টের একমাত্র অপরাজিত টিম, রোহিত শর্মার ভারত। বারবেডসের ব্রিজটাউনে শনিবার (২৯ জুন) শ্বাসরুদ্ধকর, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরপুর এক ফাইনালে ভারত দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাত রানে পরাজিত করে।

প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ভারত সাত উইকেট হারিয়ে ১৭৬ রান সংগ্রহ করে। সারা টুর্নামেন্ট নির্লিপ্ত থেকে ফাইনালে জ্বলে উঠেন ভিরাট কোহলি (৭৬), সাথে ছিলেন আক্সার প্যাটেল (৪৭) এবং শিভম দুবে (২৭)।

ভারতের ইনিংসের শুরুতে কেশভ মাহারাজ (২-২৩) এবং শেষে আনরিখ নরটিয়া (2-২৬) ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সব চেয়ে সফল বোলার।

জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা আট ইউইকেট হারিয়ে ১৬৯ রান সংগ্রহ করে। হাইনরিখ কালসেন (৫২), কোয়েন্টিন ডি কক (৩৯), ট্রিস্টান স্টাবস (৩১) এবং ডেভিড মিলার (২১) পুরো ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখলেও, শেষ দু-তিন ওভারে ভারতীয় বোলাররা খেলার নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেয়।

দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে ফেরত আসার পর এই প্রথম প্রোটিয়াস নামে পরিচিত দল কোন ফাইনালে পৌঁছায়। দেশের ক্রিকেট ইতিহাস অবশ্য এর চেয়ে অনেক দীর্ঘ – তাদের ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয় ১৮৮৯ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি অনানুষ্ঠানিক টেস্ট ম্যাচের মধ্য দিয়ে। যাত্রা ব্যাহত হয় ১৯৭০ সালে, যখন আইসিসি দেশের বর্ণবাদী “অ্যাপারথাইড” নীতির কারণে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাময়িক ভাবে নিষিদ্ধ করে।

অন্যদিকে, ১৯৭৫ সালে সীমিত ওভার ক্রিকেট বিশ্বকাপ চালু হবার পর থেকে ভারত চারবার আইসিসি বিশ্বকাপ এবং ২০২৪ নিয়ে তিনবার টি২০ বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছায়। তারা আইসিসি বিশ্বকাপ জয় করেছে দু,বার এবং এখন টি২০ বিশ্বকাপ ঘরে তুলল দ্বিতীয়বারের মত।

বিজয়ের আনন্দঃ ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা এবং দলের অন্যান্য সদস্য জয়ের আনন্দের আবেগে ভেঙ্গে পড়ছেন। ফটোঃ ২৯ জুন, ২০২৪।

শুরুতে ভারতের হোঁচট

টসে জিতে ভারত প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় (দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক এইডেন মারক্রাম টসের পর বলেন তিনি জিতলে তিনিও ব্যাটিং নিতেন।)

সবার প্রশ্ন ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার পেস বোলাররা ভারতের ওপেনিং জুটি রোহিত শর্মা আর ভিরাট কোহলির বিরুদ্ধে ব্রিজটাউনের ব্যাটিং-বান্ধব উইকেটে কতটা সুবিধা করতে পারবে। উত্তরের আভাস আসে শুরুতেই যখন ভারত প্রথম ওভারে মারকো ইয়ানসেনের বলে ১৫ রান তুলে নেয় – টি২০ ফাইনালের ইতিহাসে প্রথম ওভারে সব চেয়ে বেশি রান।

কিন্তু দ্বিতীয় ওভারে বাঁ-হাতি স্পিনার কেশভ মাহারাজ ভারতের ইন-ফরম ক্যাপ্টেন শর্মার উইকেট তুলে নেন। ওভারের শেষ বলে ঋষভ পান্ত মাহারাজের বল সুইপ করার চেষ্টা করলে ক্যাচ তুলে দেন উইকেটকিপার কোয়েন্টিন ডি ককের হাতে।

সুরিয়াকুমার ইয়াদাভ, যাকে শর্মার পরে ভারতের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাটার গণ্য করা হয়, ক্রিজে যোগ দেন কোহলির সাথে, যিনি ফাইনালের আগে এই টুর্নামেন্টে উল্লেখযোগ্য কোন ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হয়েছেন।

কিন্তু কাগিসো রাবাদার দ্বিতীয় ওভারের তৃতীয় বলে ইয়াদাভ লেগ সাইডে পুল করার চেষ্টা করলে হাইনরিখ ক্লাসেন ক্যাচ লুফে নেন।

খেলা শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার আনরিখ নরটিয়া কেশভ মাহারাজাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ফটোঃ ২৯ জুন, ২০২৪।

আক্সার প্যাটেলের প্রোমোশন

পাওয়ার প্লে শেষে তিন উইকেট হারিয়ে ৪৫ রান ছিল নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য যথেষ্ট অস্বস্তির ব্যাপার। সেখানে সুসংবাদ ছিল একটিই – কোহলি তখনো ক্রিজে, তাঁর ব্যাট থেকে দর্শনীয় শট যাচ্ছে মাঠের চতুর্দিকে। সবার মনে তখন প্রশ্ন – আজই কি ভিরাট কোহলির দিন? সারা টুর্নামেন্ট অপেক্ষা করে অবশেষ ফাইনালে কি আমরা আসল কোহলি দেখতে পাবো?

তবে ইনিংসের মাঝ পর্যায়ে কোহলি নিয়ে গবেষণা স্থগিত করে দেন আক্সার প্যাটেল, যাকে ব্যাটিং অর্ডারে প্রোমোশন দিয়ে পাঁচ নম্বরে নামানো হয়।

উইকেট হারানোর চাপে যাতে রান রেট দমে না যায়, সেই লক্ষ্যে ভারতের এই সিদ্ধান্ত বিফলে যায় নি এবং এই বাঁ-হাতি ব্যাটার দ্রুত দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের আক্রমণ শুরু করেন। একই সাথে, স্বীকৃত ব্যাটার শিভম দুবে এবং হার্দিক পান্ডিয়াকে শেষের ওভারগুলোর জন্য ধরে রাখা হয়।

মূলত প্যাটেলের হিটিং-এর কারণে কোহলির সাথে জুটির অর্ধশতক উঠে আসে ৪৫ বলে।

তবে দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটকিপার ডি কক প্যাটেলের হাফ সেঞ্চুরির স্বপ্ন চুরমার করে দেন। অসাধারণ এক থ্রো দিয়ে ডি কক প্যাটেলকে নন-স্ট্রাইকার’স এন্ডে রান আউট করেন। প্যাটেল ৩১ বলে ৪৭ রান হাঁকান, যার মধ্যে ছিল চারটি ছয়।

প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ ভিরাট কোহলি ৭৬ রানের পথে। ফটোঃ ২৯ জুন, ২০২৪।

ভিরাট কোহলির মুহূর্ত

ক্রিজের অপর প্রান্তে কোহলি ছিলেন ধৈর্যের প্রতীক – নিজের উইকেট রক্ষা করেছেন, কোন ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলেন নি, এক-দুই নিয়ে অন্য ব্যাটারকে স্ট্রাইক দিয়েছেন, যেটা ছিল দলের কৌশল।

পনেরো ওভার শেষে ভারতের স্ট্রাইক রেট আটের আশেপাশে, হাতে কোহলি, দুবে, পান্ডিয়া সহ ছয় উইকেট। রানের তুফান – বা উইকেটের ভূমিধ্বস – এর জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত।

কোহলি ৪৮ বলে অর্ধশতক সম্পন্ন করার পর তার ইনিংসের প্রথম ছয় হাঁকান। রাবাদার শেষ ওভারে – ম্যাচের ১৮তম – ভারত ১৬ রান তুলে নেয়।

কোহলির ইনিংসের সমাপ্তি আসে ১৯তম ওভারে। ইয়ানসেনের বল বাউন্ডারিতে পাঠাতে গিয়ে ধরা পড়েন রাবাদার হাতে। কোহলি ৫৯ বলে ৭৬ রান সংগ্রহ করেন, যার মধ্যে ছিল দুটি ছয় এবং ছয়টি চার।

শেষ ওভারে আনরিখ নরটিয়া দুবে এবং রাভিন্দ্রা জাদেজার উইকেট ফেলে দিয়ে ভারতের আরও বড় স্কোরের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। তবে সাত উইকেটে ১৭৬ যেকোনো টি২০ বিশ্বকাপ ফাইনালে সবচেয়ে বড় স্কোর, যা দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং টার্গেট।

হাইনরিখ ক্লাসেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে জান। ফটোঃ ২৯ জুন, ২০২৪।

স্টাবস-ডি কক জুটি

ব্যাট করতে নেমে টার্গেট আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে যায় যখন রীযা হেন্ড্রিক্স জাস্প্রিত বুম্রাহ’র বলে বোল্ড হন। তৃতীয় ওভারে অধিনায়ক মারক্রাম আরশদীপ সিংকে ড্রাইভ করার চেষ্টা করলে বল ব্যাটের কোনা ছুঁয়ে উইকেটকিপার পান্তের গ্লোভসে আটকা পরে।

ভারত দুই প্রান্ত থেকে দুই স্পিনার, আক্সার প্যাটেল এবং কুলদিপ ইয়াদাভকে এক সাথে মোতায়েন করলে ডি কক এবং নতুন ব্যাটার ট্রিস্টান স্টাবস ইনিংস স্থিতিশীল করতে সক্ষম হন। পাওয়ার প্লে শেষে প্রোটিয়াসদের রান সংখ্যা দাঁড়ায় দুই উইকেট হারিয়ে ৩৯ রান।

স্টাবস আর ডি কক জুটি ৩৩ বলে ৫০ রান তোলেন। তবে নবম ওভারে স্টাবস ক্রিজ থেকে সরে অফ স্টাম্পের বাইরে থেকে প্যাটেলের বল লেগ সাইডে মারার চেষ্টা করলে মিস করেন। বল স্ট্যাম্প নাড়িয়ে বেলস ফেলে দেয়।

স্টাবস ২১ বলে ৩১ রান সংগ্রহ করেন তবে আউট হওয়ার সাথে সাথে ডি ককের চেহারা বলে দিল এই জুটি ভঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য কতটা হতাশাব্যাঞ্জক।

ভারতের সুরিয়াকুমার ইয়াদাভ বাউন্ডারিতে অসাধারণ ক্যাচ নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ ভরসা ডেভিড মিলারকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠান। ফটোঃ ২৯, ২০২৪।

হাইনরিখ ক্লাসেন-এর আগমন

ইনিংসের মাঝ পর্যায়ে, দশম ওভার শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার রান গিয়ে দাঁড়ায় ৩ উইকেট হারিয়ে ৮১ রান। দলের আরেক বিগ হিটার হাইনরিখ ক্লাসেন ব্যাট করতে নেমেছেন। এই দুই ব্যাটার পাওয়ার হিটিং-এ পারদর্শী, কিন্তু তারা আরও ১০ ওভার ক্রিজে টিকে থাকতে পারবে কিনা, সে প্রশ্ন সবার মনে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ১০০ রান চলে আসে ১২তম ওভারে, যখন ইয়াদাভের তৃতীয় বল ক্লাসান নিজ ক্রিজের ভেতরে দাঁড়িয়ে এক্সট্রা কাভারের উপর দিয়ে ছয় হাঁকান।

দক্ষিণ আফ্রিকার সমর্থকদের আশঙ্কা ১৩তম ওভারেই সত্য প্রমাণিত হল। থার্ড ম্যান বাউন্ডারিতে ফিল্ডার মোতায়েন করার পরের বলেই ডি কক ঠিক সেদিকই বেছে নেন। আরশদিপ সিং-এর বলে সুরিয়াকুমার ইয়াদাভের হাতে ধরা পড়েন উদ্বোধনী ব্যাটার ডি কক। তিনি ৩১ বলে ৩৯ রান সংগ্রহ করে দলের ইনিংসকে সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে জান।

স্টাবস এবং ডি কক-এর বিদায়ের পর ক্লাসেন আক্সার প্যাটেলের শেষ ওভারে ২৪ রান হাঁকিয়ে দলকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন।

জাস্প্রিত বুম্রাহ ১৬তম ওভারে আক্রমণে ফেরার পর ক্লাসেন তার হাফ সেঞ্চুরি সম্পন্ন করেন। ক্লাসেনের ২৩ বলের অর্ধশতকে ছিল পাঁচটি ছয় এবং দুটি চার।

খেলা নয়, স্নায়ুর লড়াই

চার ওভার – ২৪ বল - বাকি থাকতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ২৬ রান, হাতে ছয় উইকেট। খেলা এখন আর খেলা না – স্নায়ুর লড়াই। কার মানসিক জোর কত বেশি?

প্রথম প্রাইজ ভারতের – হার্দিক পান্ডিয়ার কিছুটা ওয়াইড বল ড্রাইভ করতে গিয়ে ক্লাসেন ক্যাচ তুলে দেন পান্তের হাতে। এখন ব্যাট করতে নামবে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা। তাদের স্নায়ু হয়তো ইতোমধ্যেই ছারখার।

ভারতের ক্যাপ্টেন শর্মা ১৮তম ওভারেই দলের সবচেয়ে বিপজ্জনক বোলার বুম্রাহকে তার শেষ ওভার বল করতে বলেন। উদ্দেশ্য শুধু রান রেট আটকানো না, উইকেট নেয়াও জরুরী। দুই কাজের জন্যই বুম্রাহ আদর্শ বোলার।

ওভারের চতুর্থ বলে বুম্রাহ ইয়ানসেনের লেগ ষ্ট্যাম্প নড়িয়ে দেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ১৫৬ রানে ছয় উইকেট, এবং ভারত আবার খেলায় জোরেশোরে ফিরে আসে। বুম্রাহ’র শেষ ওভারের ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজনীয় রান রেট ১০-এ উঠে যায়।

শেষ ওভারে প্রয়োজন ১৬ রান। ডেভিড মিলারের ব্যাট বনাম পান্ডিয়ার মিডিয়াম পেস বল।

পান্ডিয়ার প্রথম বলে মিলার ছয় হাঁকালেন – কিন্তু না, বাউন্ডারিতে সুরিয়াকুমার ইয়াদাভ মাঠের ভেতরে থেকে, তারপর বল ছেড়ে মাঠের বাইরে গিয়ে, আবার মাঠের ভেতরে গিয়ে অসাধারণ একটি ক্যাচ লুফে নেন।

ইংরেজি প্রবাদ “ক্যাচেস উইন ম্যাচেস” এ’রকম মুহূর্তের কথা মাথায় রেখেই চালু হয়েছিল

মিলার আউট হবার পর দক্ষিণ আফ্রিকার আর কোন ভরসা ছিল না।