উইকিলিক্স প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান আসঞ্জ বুধবার (২৬ জুন) যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সামরিক তথ্য প্রকাশ করার ফৌজদারি অভিযোগে দোষ স্বীকার করার জন্য আদলতে হাজির হবেন। একটি সমঝোতার অধীনে তিনি স্বীকারোক্তি দেবেন, যার ফলে তিনি মুক্তি পেয়ে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত যাবেন।
আসঞ্জ সাত বছর লন্ডনে একুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গ্রেফতার হবার পর তিনি পাঁচ বছর ব্রিটেনের কারাগারে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আইনগত লড়াই চালিয়ে গেছেন।
মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনের আওতাধীন প্রশান্ত মহাসাগরীয় নর্দার্ন মারিয়ানা আইল্যান্ডসের রাজধানী সাইপানে। এর মাধ্যমে আসঞ্জকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বছরের পর বছর যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, তার চমক লাগানো সমাপ্তি ঘটবে।
লক্ষ লক্ষ স্পর্শকাতর সামরিক নথিপত্র ফাঁস করে দেয়ার জন্য উইকিলিক্স-এর প্রকাশক আসঞ্জকে যেমন অনেকে একজন হিরো হিসেবে দেখেন, আবার অনেকে তাঁকে একজন বেপরোয়া অপরাধী হিসেবে গণ্য করেন।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) আসঞ্জকে নিয়ে একটি যাত্রীবাহী বিমান ব্যাংকক থেকে সাইপানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। যে ভাড়া করা বিমানে তিনি ভ্রমণ করছেন বলে তাঁর স্ত্রী স্টেলা আসঞ্জ নিশ্চিত করেছেন, সেই বিমান ব্যাংককের ডন মং আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে ।
গোপন শুনানিতে জামিন
ব্রিটেনে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে এক গোপন শুনানিতে জামিন দেয়ার পর আসঞ্জকে সোমবার (২৪ জুন) সন্ধ্যায় ব্রিটেন ছেড়ে চলে গেছেন।
“তিনি প্রথম গ্রেফতার হওয়ার সাড়ে ১৩ বছর এবং দুটি প্রত্যর্পণ অনুরোধের পর গতকাল জুলিয়ান আসঞ্জ ইউকে ছেড়ে চলে গেছেন,” ইংল্যান্ড আর ওয়েলস-এর প্রধান প্রসেকিউটর স্টিফেন পারকিন্সন বলেন। “গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার জামিনের শুনানি হয়, যেটা তাঁর অনুরোধে গোপনে করা হয়।”
স্টেলা আসঞ্জ অস্ট্রেলিয়া থেকে বিবিসিকে বলেন গত ৭২ ঘণ্টায় সমঝোতা হবে কি হবে না, তা বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু এখন তিনি খবর শুনে উল্লসিত। স্টেলা আসঞ্জ, একজন আইনজীবী যিনি উইকিলিক্স প্রতিষ্ঠাতাকে ২০২২ সালে কারাগারে বিয়ে করেন, বলেন যে বিচারকের অনুমোদনের পর সমঝোতার বিস্তারিত জনসমক্ষে জানানো হবে।
“বিচারক অনুমোদন দেয়ার পর সে মুক্তি পাবে,” তিনি বলেন। তিনি আরও বলেন, ঘটনা যে আসলেই ঘটছে, সেটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ভুমিকা
উইকিলিক্সের প্রধান সম্পাদক ক্রিস্টিন হ্রাফন্সন বলেন যে, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ ক্রমশ জড়িত হবার পরই আসঞ্জ নিয়ে সমঝোতা হয়।
“এটা একটি দীর্ঘ, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল, যেটা বেশ কিছু সময় ধরে চলছে। লড়াইটা কঠিন ছিল, কিন্তু এখন মূল দৃষ্টি হচ্ছে জুলিয়ানকে তাঁর পরিবারের সাথে মিলিত করা,” হ্রাফন্সন সংবাদ সংস্থা পিএ-কে বলেন।
আলবানিজ সংসদকে জানান, অস্ট্রেলিয়ার একজন দূত লন্ডন থেকে আসঞ্জের সাথে বিমানে উঠেছেন।
“মিস্টার আসঞ্জের কর্মকাণ্ড নিয়ে মানুষের যে মত থাকুক না কেন, এই মামলা অনেক বেশি সময় ধরে টানা হয়েছে,” আলবানিজ বলেন।
“তাঁকে কারাগারে বন্দি রেখে লাভ করার কিছু নেই, এবং আমরা চাই তাঁকে অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর নিজ বাড়িতে নিয়ে আসতে।”
উইকিলিক্স সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ দেয়া এক বিবৃতিতে সমঝোতার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলে, “যারা আমদের পাশে ছিল, আমাদের জন্য লড়াই করেছে এবং তাঁর মুক্তির জন্য পুরোপুরি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল,” তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
সমঝোতা আর স্বীকারোক্তি
সোমবার জানা যায়, উইকিলিক্স প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান আসঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের সাথে এক সমঝাতায় এসেছেন, যার ফলে তার কয়েক বছর ধরে চলা আইনগত সঙ্কটের সমাধান হবে এবং তিনি ব্রিটেনে কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন। সমঝোতার অংশ হিসেবে আসঞ্জ তাঁর বিরুদ্ধে আনা একটি ফৌজদারি অভিযোগ স্বীকার করবেন বলে আদালতে পেশ করা নথিপত্রে জানা গেছে।
এই আইনগত লড়াই একাধিক মহাদেশে বিস্তৃত ছিল, এবং তার মূল বিষয় ছিল উইকিলিক্সে এক রাশ গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করা।
আসঞ্জ বুধবার (২৬ জুন) পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের আওতাভুক্ত মারিয়ানা আইল্যন্ডস-এর ফেডেরাল আদালতে হাজিরা দেবেন। সেখানে তিনি এস্পিওনেজ অ্যাকট-এর অধিনে, গোপনীয় জাতীয় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য বেআইনি ভাবে সংগ্রহ এবং বিতরণ করার অভিযোগ স্বীকার করবেন। আদালতে পেশ করা চিঠিতে জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট এ’তথ্য জানিয়েছে।
অভিযোগে স্বীকারোক্তি, যেটা বিচারককে অনুমোদন করতে হবে, এই ফৌজদারি মামলা এবং এই প্রকাশকের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দীর্ঘ প্রচেষ্টার হঠাৎ সমাপ্তি ঘটাবে। আসঞ্জের ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় গোপন তথ্য প্রকাশকারী ওয়েবসাইট তাঁকে অনেক স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রবক্তার কাছে প্রিয় করে তোলে।
অন্য দিকে, তদন্তকারীরা বারবার বলেছে, আসঞ্জ স্পর্শকাতর তথ্য রক্ষার আইন ভঙ্গ করেন এবং দেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলেন।
স্বীকারোক্তি, তারপর অস্ট্রেলিয়া
ধারনা করা হচ্ছে, মারিয়ানা আইল্যান্ডস-এর সবচেয়ে বড় দীপ সাইপানে স্বীকারোক্তি এবং সাজা ঘোষণার পর আসঞ্জ অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাবেন। মামলার শুনানি সাইপানে হচ্ছে কারণ, আসঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্য ভূখণ্ডে যেতে চান নি, এবং সাইপান অস্ট্রেলিয়ার কাছে।
এই সমঝোতার মূল দিক হচ্ছে আসঞ্জ অপরাধ স্বীকার করবেন, এবং একই সাথে কারাগারে আর কোন সময় কাটাতে হবে না। তিনি লন্ডনে একুয়েডর দূতাবাসে কয়েক বছর আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর পর তিনি পাঁচ বছর ব্রিটেনের বেলমারশ কারাগারে আটক ছিলেন, যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ আটকাতে আদলতে লড়াই করে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবীরা আসঞ্জের অপরাধের জন্য পাঁচ বছরের সাজায় একমত হয়েছেন, যে পাঁচ বছর তিনি ইতোমধ্যেই কারাগারে কাটিয়েছেন।
গত মাসে আসঞ্জ তাঁর প্রত্যর্পণ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি পান। তাঁর আইনজীবীরা যুক্তি দেখান যে, তিনি আমেরিকান আদালতে বাক স্বাধীনতা পাওয়ার যথেষ্ট নিশ্চয়তা যুক্তরাষ্ট্র দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইরাক এবং আফগানিস্তানে প্রশ্নবিদ্ধ সামরিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ করার জন্য আসঞ্জ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছেন। উইকিলিক্স-এর প্রকাশ করা মধ্যে ছিল ২০০৭ সালের একটি ভিডিও, যেখানে দেখা গেল বাগদাদে একটি আমেরিকান আপাচে হেলিকপ্টার আক্রমণে ১১ জন নিহত হবার ঘটনা, যার মধ্যে রয়টার্সের দুজন সাংবাদিক ছিলেন।